২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
বাক-স্বাধীনতা কোণঠাসা

মতপ্রকাশের অধিকার দিন

-

বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে এখন জোর আলোচনা চলছে। ২০১৮ সালে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে একটি নতুন আইনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিপুল ক্ষমতা দিয়েছে। এর ফলে যারা বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীন মতামত দিতেন তারা অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে গেছেন। ব্যক্তি ও সংগঠনের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমগুলো ¤্রয়িমাণ হয়ে যায় এই আইন প্রণয়নের ফলে। কোনো একটা ব্যাপারে কিছু বলার আগে সবাইকে সাতবার ভেবে নিতে হচ্ছে পুলিশ তাকে আটক করে নিয়ে যাবে কি না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এ আইন প্রণয়নের আগে থেকেও বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ওপর সরকারের চরম চাপ ছিল। ফলে তারা আগে থেকেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খুব কমই ভোগ করছিলেন। দেশে দেশে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউজের ২০২১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার অত্যন্ত সীমিত হয়ে আছে।
ফ্রিডম হাউজ তিনটি মোটা দাগে বিশ্বের ২১০টি দেশের জনসাধারণের বাক-স্বাধীনতার পরিমাপ করেছে। মোট এক শ’ স্কোর দিয়ে দেশগুলোর অবস্থান প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে যেসব দেশের স্কোর এক থেকে ৩৪ এর মধ্যে তারা ‘স্বাধীন নয়’। যাদের স্কোর ৩৫ থেকে ৭১ তারা ‘অংশিক স্বাধীন’ এবং যাদের স্কোর এর ওপরে রয়েছে তারা ‘স্বাধীন’ বলা হয়েছে। সংস্থাটির গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আমরা আংশিক স্বাধীনতা ভোগ করছি। আমাদের প্রাপ্ত স্কোর ‘স্বাধীন নয়’ এর চেয়ে কিছুটা উপরে রয়েছে। উপমহাদেশের ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ হয়ে থাকা কাশ্মির ২৮ এবং আধা-স্বাধীন আফগানিস্তান ২৭ স্কোর নিয়ে এ অঞ্চলে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। আমাদের স্কোর ৩৯। আমাদের স্বাধীনতা যে কমছে বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিক ক্রমাবনতি থেকে তা বোঝা যায়। ২০১৭ সালে আমাদের স্কোর ছিল ৪৭ এবং এর পরের বছর তা কমে দাঁড়ায় ৪৫। এর পরের বছর আরো বেশ খানিকটা কমে হয়েছে ৪১।
রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার এই দুই ভাগে ফ্রিডম হাউজ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। এর মধ্যে রাজনৈতিক অধিকারের জন্য মোট স্কোর ৪০-এর মধ্যে বাংলাদেশের অর্জন ১৫। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর সব ধরনের কর্মসূচি অবাধে পরিচালনা করার অধিকার সংবিধান দিয়েছে। দেশে এখন একটি জনসভা করার জন্য পুলিশের অনুমতি পাওয়া যায় না। প্রধান বিরোধীদলকে এ ধরনের কর্মসূচি করার অনুমতি চেয়ে প্রায়ই ব্যর্থ হতে হয়। প্রতিবাদ কর্মসূচি করার কোনো অধিকার নেই বললেই চলে। সাধারণত রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে নিরীহ মানববন্ধনের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি করার অধিকার সীমিত হয়ে গেছে। তাও আবার জাতীয় প্রেস ক্লাব বা শহীদ মিনারের পাদদেশে এমন নিরীহ কর্মসূচিতে পুলিশ নির্বিচারে অতর্কিত হামলা চালিয়ে কর্মসূচি ভণ্ডুল করে দিচ্ছে। নাগরিক স্বাধীনতার জন্য রাখা ৬০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশের অর্জন ২৪। সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক লেখক মুশতাকের মৃত্যুর পর আমরা জানতে পারলাম, তার নামে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে। কারণ তিনিসহ কয়েকজন সামাজিক মাধ্যমে কিছু অনিয়মের সমালোচনা করে পোস্ট দিয়েছেন এবং একজন দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে কার্টুন এঁকেছেন। অথচ এগুলো দেশের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়িয়ে তারা করেছেন। এ জন্য কোনোভাবে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে আনা যায় না। নাগরিকদের স্বাধীনতা কতটুকু রয়েছে এই ঘটনার পর তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাংলাদেশের জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতটুকু রয়েছে সেটা বাইরের কোনো সংস্থার মূল্যায়নের প্রয়োজন নেই। দেশের মানুষই এর প্রকৃত মূল্যায়ন করতে সক্ষম। মানুষ আরো আগে থেকে এই কষ্টকর পরিস্থিতির শিকার হয়ে আসছেন। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার তারা পাচ্ছেন না। সরকারকে এ অবস্থায় বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে। মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে জাতীয় কোনো কল্যাণ অর্জিত হতে পারে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল ছাড়াও সরকারকে এই মানসিকতা গ্রহণ করতে হবে যে, কারো ওপর চাপ প্রয়োগ করে মতামত দেয়ার অধিকার দমিত রাখা চূড়ান্ত বিচারে কারো জন্য লাভজনক হবে না। এই দমবন্ধ অবস্থা থেকে সবাই পরিত্রাণ চায়।


আরো সংবাদ



premium cement