২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`
অবাধে দেশের অর্থ পাচার

প্রতিরোধে গরজ নেই

-

দেশের অর্থ নানাভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কোনো-না-কোনো ঘটনার সূত্রে বিষয়টি সামনে চলে আসে। এরপর কিছু দিন চার দিকে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইতে দেখা যায়। কখনো কোনো গণমাধ্যমের সাড়া জাগানো প্রতিবেদন, কোনো দায়িত্ববান কর্তাব্যক্তির মন্তব্য ইত্যাদি আমাদের নাগরিক চেতনায় সাময়িক আলোড়ন তোলে। এরপর পরিস্থিতি থিতিয়ে আসে। সবকিছু থেকে যায় আগের মতোই নিস্তরঙ্গ। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া বা প্রতিকারের উপায় খুঁজে বের করা হয়েছে এমনটা প্রায়ই দেখা যায় না।
গত রোববার উচ্চ আদালতের একটি আদেশ আমাদের চেতনায় একটু নাড়া দিয়েছে। দু’জন আইনজীবীর রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে নাÑ এ মর্মে রুল জারি করেছেন। রিটে বাংলাদেশ থেকে বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংক, বিশেষ করে সুইস ব্যাংকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা চাওয়া হয়। হাইকোর্টের রুলে পানামা পেপার্স ও প্যারাডাইস পেপারসে যাদের নাম এসেছে তাদের বিরুদ্ধে কেন তদন্ত করা হবে নাÑ তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, অ্যাটর্নি জেনারেল, বাণিজ্য সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ সংশ্লিষ্ট ১৫ জনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
রিটের শুনানিতে দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আলোচিত পানামা ও প্যারাডাইস পেপারে যাদের নাম এসেছে তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। সুইস ব্যাংক থেকে টাকা আনার বিষয়ে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ইমিগ্রেশন পুলিশ, বিএফআইইউ-সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছে। বাংলাদেশে সরকারি যেকোনো সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কে এর চেয়ে ভালো কোনো জবাব কখনো আশা করার কারণ আছে বলে মনে হয় না। পানামা পেপারসের ঘটনা ২০১৬ সালের। তাতে ৫৬ বাংলাদেশী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছিল অর্থপাচারকারী হিসেবে। সেই অনুসন্ধান ২০২১ সালের মার্চে এসে এখনো চালিয়ে যাচ্ছে দুদক। অনুসন্ধানের কোনো ফল তারা জানাতে পারেননি। আসলে ঘটনা হলো, ওই সময় ৫৬ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। এরপর অজানা কারণে জিজ্ঞাসাবাদ বন্ধ রাখা হয়। পাঁচ বছরে এ-ই যদি হয় অগ্রগতি তাহলে জাতীয় শত্রু হিসেবে চিহ্নিত এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে আমাদের সম্ভবত অনন্তকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর দুদকের অনুসন্ধান কিছু ক্ষেত্রে কোনো অদৃশ্য ইঙ্গিতে শুরু আর কিছু ক্ষেত্রে বন্ধ হয়, তা সম্ভবত দেশবাসীর খুব একটা অজানা নয়।
শুধু যে দুদকই নিষ্ক্রিয় থেকেছে এমন নয়। অর্থপাচার রোধের যতগুলো ব্যবস্থাপত্র দেশে আছে কেউই সক্রিয় ভূমিকা রাখেনি। গত বছর নভেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং কানাডায় অর্থপাচারের তথ্য প্রকাশ করে নাগরিক চেতনায় ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে কানাডায় অর্থপাচারকারী ২৮ ব্যক্তির তথ্য তার কাছে আছে। তাদের মধ্যে মাত্র চারজন রাজনীতিক। বাকি সবাই সরকারি আমলা। মন্ত্রীর বক্তব্যে রাজনীতিকদের অপরাধ গৌণ করে দেখানোর প্রবণতা কাজ করে থাকতে পারে বলে যদি কেউ মনে করেন, তাকে দোষ দেয়া যাবে কি না সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। মূল বিষয় হলো, মন্ত্রীর কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার পরও উল্লিখিত ২৮ জনের মধ্যে একজনের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এটিকে কী বলা যেতে পারে? একটি দেশের মন্ত্রী তথ্য জানার পরও যদি অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হয়; তাহলে বলতে হবে, সরকার অপরাধীদের লালনকারী এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যার্থতার পরিচয় দিচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের কয়েক দিন পর কানাডা থেকে একজন সাংবাদিক দেশের একটি প্রধান জাতীয় দৈনিকে তথ্য প্রকাশ করেন যে, ‘গত পাঁচ-ছয় মাসে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ টাকা কানাডায় এসেছে, গত কয়েক বছরেও তা আসেনি, এমন কথা এখন টরন্টোর বাংলাদেশী কমিউনিটিতে ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়।’ এর অর্থ হলো, দেশ থেকে বেশুমার টাকা পাচার হচ্ছে এবং তা হচ্ছে অবাধে। বান্তবতা হলো দেশের অর্থ পাচার প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষেরই আন্তরিকতা রয়েছে বলে মনে হয় না। এর পর বাড়তি মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।


আরো সংবাদ



premium cement