২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
কারাগারে লেখকের মৃত্যু

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত হোক

-

বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের আমলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে ভিন্নমত একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আইনি বেড়াজাল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ি ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীর হুমকি-ধমকিতে নাগরিকরা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশে শঙ্কিত ও দ্বিধাগ্রস্ত। এ ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সর্বশেষ এই মামলায় কারাগারে আটক লেখক মুশতাকের মৃত্যু হয়েছে। দেশে হেফাজতে মৃত্যু সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। মৃত্যুর সে মিছিলে মুশতাকের নামটি সংখ্যাগত আরেকটি সংযোজন মাত্র। এই মৃত্যুতে ফের পরিষ্কার হলো, এ ধরনের আইন নিবর্তনমূলক। এ আইনে একজন অপরাধী কি না তার চেয়ে বড় কথা, এতে সরকারের ইচ্ছার প্রাধান্য থাকে বেশি। তারই সর্বশেষ শিকার হলেন লেখক মুশতাক।
মুশতাকের সাথে এই মামলায় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, রাষ্ট্রচিন্তার কর্মী দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়াও গ্রেফতার হন। তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও গুজব ছড়ানোর আভিযোগ আনা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতে, তারা ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এ অপরাধ করছিলেন। তাদের মধ্যে দিদারকে জামিন দিলেও বাকি দু’জনকে বন্দী রাখা হয়েছিল। তাদের স্বজনের বরাতে সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত খবরে জানা যায়, তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। কিশোর ও মুশতাক উভয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেও জামিন মেলেনি। এখন তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপের নানা খবর প্রচার হচ্ছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ওই মামলায় সাক্ষীরা অভিযুক্তদের ব্যাপারে খুব সামান্য জানতেন। এমনকি সাক্ষীদের ব্যক্তিগত অবস্থান ও পদবি অনুল্লেখযোগ্য। পিয়ন ও সিকিউরিটি গার্ডদের সাক্ষী রাখা হয়েছে। তারা ডিজিটাল মাধ্যমে কিভাবে অপরাধ সংঘটিত হয়, সে সম্পর্কে খুব কমই অবহিত। আদালতে দেয়া ছয়জনের সাক্ষ্য দাঁড়ি, কমাসহ হুবহু এক।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করার চেষ্টার মধ্যে কোনো ধরনের আন্তরিকতার ছাপ নেই। রয়েছে জোরজবরদস্তি করে দমানোর চেষ্টা। লেখক কার্টুনিস্টরা অপরাধের সাথে খুব কমই জড়িত থাকেন। এ ধরনের লোকদের অপরাধের জোরালো প্রমাণ না থাকলেও সরকার তাদের আটক করে রাখতে পছন্দ করছে। অথচ একই সময় দণ্ডপ্রাপ্ত খুনের আসামিদের অব্যাহতি দেয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। ঢাকার একজন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে র্যাবের পক্ষ থেকে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করা হলেও পরে পুলিশের তদন্তে নির্দোষ দেখানো হয়। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত-পাল্টা তদন্ত এখন প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা আর্টিক্যাল ১৯-এর বার্ষিক প্রতিবেদন মতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৯৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৪১টি মামলার আসামি করা হয়েছে ৭৫ জন পেশাদার সাংবাদিককে। এসব মামলার ১৯টি করেছেন ক্ষমতাসীন দলের জাতীয় সংসদের সদস্য কিংবা তাদের ঘনিষ্ঠজনরা। এ আইনে ২০১৯ সালে ৬৩টি মামলা হয়েছিল। এটির ব্যবহার যে সরকার ও দলীয় লোকদের কাছে বহু গুণে বেড়ে গেছে, দুই বছরের মামলার সংখ্যায় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্ট, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আরো বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা। তবু সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের অনুরোধ-আহ্বান আমলে নেয়নি। সরকার সত্যিকার অর্থে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে এ আইন করলে এসব ব্যক্তিকে গ্রেফতারের প্রয়োজন পড়ত না। সরকারি হেফাজতে থাকা অবস্থায় অনেকের প্রাণহানি হয়েছে। তাই লেখক মুশতাকসহ প্রত্যেকটি হেফাজতে মৃত্যুর স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করি আমরা। একই সাথে যাদের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ মেলেনি তাদের মুক্তি দেয়া হোক। সচেতন সব নাগরিকের প্রত্যাশা, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার সুরক্ষা করবে সরকার।


আরো সংবাদ



premium cement