২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
কুমারখালীর তাঁতশিল্পের দুর্দশা

কবে ঘুচবে এ দুর্দিন?

-

কুষ্টিয়ার কুমারখালী বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের স্মৃতিধন্য শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, প্রতিবাদী সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ, দেশবিখ্যাত গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প প্রভৃতির পাশাপাশি তাঁতশিল্পও দেশের পশ্চিমাঞ্চলের এই জনপদের পরিচিতি বৃদ্ধি করেছে। বিশেষ করে কুমারখালীর তাঁতশিল্প অতীত থেকেই খ্যাতি কুড়িয়েছে। কিন্তু ইদানিং এখানকার তাঁতীরা ও তাঁতশিল্প অব্যাহত দুর্ভোগের সম্মুখীন বলে নয়া দিগন্তে এক সচিত্র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কুমারখালী প্রতিনিধির পাঠানো এই প্রতিবেদনে জানানো হয় যে, এখানকার জনপ্রিয় তাঁতশিল্প দিন দিন ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। গ্যাসের অভাব, বিদ্যুৎ ও কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া, পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্কট প্রভৃতি কারণে স্থানীয় তাঁতশিল্পীরা নিদারুণ দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন। ফলে বিপন্ন হয়ে পড়ছে প্রায় দেড় লাখ মানুষের জীবিকা সৃষ্টিকারী শিল্পটি।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের পরিসংখ্যানমাফিক, কুমারখালীসহ কুষ্টিয়া জেলায় ১৫ হাজার পাওয়ার লুম ও দুই হাজার হ্যান্ডলুমে কাজ করছেন মোট এক লাখ ৪০ হাজার কর্মী। চলমান করোনা মহামারীর দরুন তাঁতশিল্পের শ্রমিক-মালিক নির্বিশেষে সংশ্লিষ্ট সবাই অর্থনৈতিক সঙ্কটের শিকার। তদুপরি সুতা ও রঙসহ কাঁচামালের জন্য ক্রমবর্ধমান ব্যয় এবং নানা প্রতিকূলতার কারণে ক্রমেই বন্ধ করে দিতে হচ্ছে তাঁত কারখানাগুলো। এতে হাজার হাজার শ্রমজীবী তাদের পেশা হারাচ্ছেন এবং হয়ে যাচ্ছেন কর্মহীন। প্রধানত গ্যাস না থাকা এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের বাজারে কুমারখালীর তাঁতবস্ত্র টিকতে পারছে না। জানা গেছে, কুমারখালী উপজেলায় বর্তমানে হাতেগোনা অল্প ক’টি স্থানে শুধু গামছা তৈরি করা হচ্ছে তাঁতে। তবে অব্যাহত লোকসানে এবং পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় হয়তো এটাও বন্ধ হয়ে যাবে। তাঁতিরা আফসোস করে বলেছেন, অতীতে এলাকার তাঁতপল্লীগুলো দিনরাত মুখর থাকত তাঁতের শব্দে। অথচ এখন সেখানে বিরাজ করছে নীরবতা। বাপ-দাদার এ পেশা আঁকড়ে আছে কয়েকটি পরিবার মাত্র। উল্লেখ্য, ‘কারিগর’ নামে অভিহিত তন্তুবায়ীরা সুতা কিনে এতে প্রয়োজনীয় রঙ দিয়ে তাঁতে সুনিপুণভাবে বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র তৈরি করতেন। একদা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করা হতো কুমারখালীর তাঁতের চাদর, বেডশিট, তোয়ালে, গামছা প্রভৃতি। বেডশিট এখন অনেকটাই স্মৃতি। কারণ প্রিন্ট তার স্থান দখল করেছে। তাঁতশিল্পে বিরাজমান সমস্যার আশু সুরাহা করা না হলে গামছাও একসময় হারিয়ে যেতে পারে। তখন প্রিন্ট বেডশিটের মতো গামছার পরিণতি হবে। কুমারখালী শহরের জাফর শেখের মতো গামছা তৈরি করার পৈতৃক পেশায় কেউ কেউ বহু কষ্টে টিকে রয়েছেন। এ জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ পর্যন্ত নিতে হচ্ছে। কেউবা কেবল তোয়ালের চাহিদার ওপর নির্ভর করে তাঁতের কাজ করছেন।
একসময়ে কুষ্টিয়ার কুমারখালী ও নিকটবর্তী তিনটি উপজেলায় মোট ৮০ হাজারের অধিক তাঁতি ছিলেন। তখন কুষ্টিয়া জেলায় বস্ত্রশিল্পে বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল ৩০০ কোটি টাকারও বেশি। সারা দেশের মোটা কাপড়ের ৬৩ শতাংশই কুমারখালীর তাঁতিরা পূরণ করতেন। তবে ১৯৯০ সালের পর তা কমে নেমে এসেছে মাত্র ৩৫ শতাংশে। অনেকে লুঙ্গি বানিয়ে কোনোমতে জীবন যাপন করছেন। জাতীয় ও আন্তর্জান্তিক বাণিজ্যমেলায় আগে কুমারখালীর অন্তত পাঁচটি প্রতিষ্ঠান হস্তশিল্পে বারবার পদক পেলেও ঐতিহ্য আর ধরে রাখতে পারছে না। দেশ-বিদেশে সব পণ্যের দাম বাড়লেও তাঁতবস্ত্রের দাম বাড়েনি। ফলে অর্ধলাখ তাঁতি তাদের এ পেশা ত্যাগ করেছেন।
বিনা সুদে ঋণসহ পরিকল্পিত উপায়ে তাঁতশিল্প রক্ষার উদ্যোগ নেয়াই সময়ের দাবি।

 


আরো সংবাদ



premium cement