১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`
প্রকল্প নকশা-প্রাক্কলনে অতিরিক্ত ব্যয়

রাষ্ট্রীয় অর্থের হরিলুট

-

দেশে সরকারি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ গচ্চা দেয়ার বিষয়টি নতুন নয়, এটি বহু পুরনো একটি প্রবণতা। মূলত রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় রোধের কথা বিবেচনায় না রাখায় প্রকল্প ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ, বাংলাদেশে এখনো প্রকল্পের খসড়া প্রণয়ন ব্যয় প্রাক্কলনে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় না। নকশা করার পর পরামর্শকের ওপর সব ছেড়ে দেয়া হয়। তারা ইচ্ছামতো ব্যয়ের প্রাক্কলন করে থাকেন। এতে করে শুরুতেই কয়েক গুণ বেশি খরচ ধরার সুযোগ তৈরি হয়।
টেন্ডারপ্রক্রিয়া নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। অভিযোগ রয়েছে, ই-টেন্ডারের আইনি মারপ্যাঁচে ঘুরেফিরে কাজ পাচ্ছে কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ছোট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বিতীয় পক্ষ হয়ে কাজে অংশ নিচ্ছে। কয়েক হাত ঘুরে বাস্তবায়ন হওয়া উন্নয়ন প্রকল্প সময়মতো শেষ হচ্ছে না। ফলে একই প্রকল্পে বারবার ডিপিপি সংশোধিত হচ্ছে। বাড়ছে প্রকল্পের ব্যয়ও। আর একই প্রতিষ্ঠান বেশি কাজ পাওয়ায় সময়মতো শেষ হচ্ছে না প্রকল্প। প্রকল্প ব্যয় হ্রাসের উদ্ভাবনী কোনো কার্যকর ভাবনা না থাকায় প্রতি বছর সরকারি হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেই অর্থের বেশির ভাগ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। এভাবে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ লুট করা হচ্ছে।
প্রকল্প প্রস্তাবনা বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়, সরকারি প্রতিটি প্রকল্পেই গড়ে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত অর্থ ধরা থাকে, যাকে ফ্রন্ট লোডিং বলা হয়। এই ফ্রন্ট লোডিংয়ের টাকাটা শুরুতেই ভাগবাটোয়ারা হয়। জানা গেছে, কাজ শুরু না হতেই ১০ শতাংশ অগ্রিম বিল করা হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধাপে টাকা উত্তোলন করা হলেও প্রকৃত অর্থে প্রকল্পের কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। তখন বাধ্য হয়ে প্রকল্প ব্যয় বাড়াতে হয়। যেহেতু এ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের যোগসাজশ থাকে, তাই নজরদারির বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব পায় না। এমনো হয়, পরামর্শকদের টাকা দেয়া হলেও প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদন পায় না। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি একটি সংস্থার ২৯ তলাবিশিষ্ট প্রধান কার্যালয় নির্মাণ ব্যয় ৯০০ কোটি টাকা ধরা হয়। প্রতি বর্গফুট নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ২৬৫ টাকা, যা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। বাস্তবে চলতি সময়ে বেসরকারিভাবে সর্বোচ্চ নির্মাণ ব্যয় প্রতি বর্গফুট দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার টাকার বেশি হয় না। অথচ সরকারি প্রকল্প বিধায় তিন গুণের বেশি ব্যয় ধরা হয়। তবে আশার কথা হলো, শেষ পর্যন্ত সেটি অনুমোদন হয়নি। কিন্তু পরামর্শকদের সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ঠিকই দিতে হয়েছে।
ব্যয় সঙ্কোচনে সর্বত্রই এখন নকশার পর মডেলিং করা হয়। বিল্ডিং ইনফরমেশন মডেলিং বা বিম পদ্ধতিতে মডেলিং করার মাধ্যমে খরচ প্রায় ২২ থেকে ২৫ শতাংশ কমে যায়। সময় বাঁচে ১৯-২৩ শতাংশ। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্ত অধিদফতরের ব্যয় বরাদ্দ সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, শুধু থ্রিডি মডেলিংয়েই বছরে ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ২৫ কোটি টাকা। তিন বছরে এই ব্যয় দাঁড়ায় ৭৫ কোটি টাকা। যদিও ভবনের উচ্চতা অনুযায়ী এ ব্যয় ভিন্ন হয়ে থাকে। অথচ মাত্র দুই কোটি টাকা ব্যয়ে এটি করা সম্ভব। তা-ও তিন বছরের জন্য। কারণ একটি লাইসেন্সের মেয়াদ তিন বছর থাকে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরের কিছু কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রয়োজন হবে মাত্র। তাতে ভবিষ্যতের জন্য দক্ষতা বাড়বে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নতি করছে। এ খাতের অবকাঠামো উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে। এই বিবেচনায় তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের অভিমত, উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়নে তথ্যপ্রযুক্তির মিশেল ঘটিয়ে ব্যয় যেমন সাশ্রয় সম্ভব, তেমনি গুণমান নিশ্চিত করাও সহজ হবে। শুধু গণপূর্ত অধিদফতরের উদাহরণ দিয়ে তারা বলেন, প্রকল্প নকশা তৈরি ও প্রাক্কলন পর্যায়ে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি গচ্চা যাচ্ছে। প্রকল্প গ্রহণ পর্যায়ে যদি তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাক্কলন করা যেত, তাহলে বছরে প্রকল্প ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশের মতো সাশ্রয় করা সম্ভব হতো।


আরো সংবাদ



premium cement