২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
বিচার পাচ্ছেন না ধর্ষিতারা

স্বচ্ছতাই কাম্য

-

বাংলাদেশে বেশির ভাগ সঙ্কটের একটি সাময়িক সমাধানের চেষ্টা করা হয়। সরকার বা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক গোষ্ঠী উদ্ভূত পরিস্থিতি যেনতেনভাবে সামাল দিতে চায়। এমন প্রচেষ্টা আমাদের জন্য কোনো ধরনের ইতিবাচক ফল বয়ে আনছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা ক্ষতিকর হয়ে যাচ্ছে দেশের জন্য। ধর্ষণ এ দেশে অহরহ ঘটছে। ক্ষমতার ছাতার আশ্রয় পেয়ে ধর্ষকদের ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে। নোয়াখালীতে এক বিধবা মহিলাকে বিবস্ত্র করে একটি গোষ্ঠী তা আবার সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। ওই দুর্বৃত্তরা আবার এটিকে পুঁজি করে তাকে ধর্ষণচেষ্টা করেছে। তাকে অপমান-নির্যাতন করেছে। একই সময়ে সিলেটের এম সি কলেজে ক্ষামতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের ছাতার নিচে থেকে একদল সন্ত্রাসী স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে। এ ধরনের উপর্যুপরি ঘটনার ফলে সারা দেশের মানুষ ফুঁসে ওঠে। সরকার ঠিক এমন একটা পরিস্থিতিতে ধর্ষণের শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত করেছে। এটি একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আইন। উত্তেজিত জনসাধারণকে ঠাণ্ডা করার জন্য সরকার নতুন আইন করেছে। কিন্তু এই আইনের মাধ্যমে দেশে ধর্ষণ রোধ আসলে সম্ভব নয়। এ আইন করার পরও ধর্ষণ অব্যাহত রয়েছে।
গত রোববার শরীয়তপুরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণের বিচারের জন্য এক কলেজছাত্রী গড়াগড়ি করে কান্না করছিলেন। তার ওই গগনবিদারী কান্নার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। ভুক্তভোগীর গগনবিদারী ওই আহাজারির মধ্যে ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইনের শাসনের ঘাটতিই যে প্রধান সেটিই প্রমাণিত হয়। জাজিরা থানার কলেজপড়–য়া মেয়েটি স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থায় সামান্য বেতনে চাকরি করতেন। তিনি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাকে গত বছরের ২৯ জুন সন্ধ্যায় ডেকে নিয়ে পাশের বাড়ির এক বাসিন্দা ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ। ওই সময় দুই নারী তাকে উদ্ধার করেন। তখন ওই নারীরা বিভিন্ন মাধ্যমে ধর্ষণ ঘটনার চাক্ষুষ বর্ণনা দেন। অন্য দিকে মেয়েটি ভয়ে পালিয়ে যান গ্রামের বাড়িতে। এবার এই দুই নারী আদালতে সাক্ষী দিতে এসে জানান, ‘তারা ওই ঘটনার ব্যাপারে কিছুই জানেন না।’ মেয়েটির বাবা জানান, মেয়েটি ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না। এখন সাক্ষীরাও ঘটনার উল্টো সাক্ষী দিচ্ছেন। কোথাও থেকে তারা সহযোগিতা পাচ্ছেন না। দরিদ্র অসহায় মেয়েটি বিচার পাবেন না এই আশঙ্কায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছেন।
কোনো একটি অপরাধ বন্ধ করার জন্য উপযুক্ত বিচার প্রয়োজন। এখন যদি ক্ষমতার দাপটের কাছে উল্টো ধর্ষণের শিকার মেয়েটির হয়রানি বেড়ে যায় তাহলে ধর্ষণ আরো বাড়বে। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার পর এখনো ধর্ষণ কমেনি। প্রত্যেক দিন নতুন নতুন ধর্ষণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। গত সোমবারের পত্রিকায় স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের খবর রয়েছে। এ ছাড়া ফরিদপুরে কিশোরী, বগুড়ায় স্কুলছাত্রী, নাটোরে গৃহবধূ ও শেরপুরে শিশুকে ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। প্রতিদিনের পত্রিকায় ধর্ষণের খবর রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ৯৭৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০৮টি ঘটেছে গণধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষণের এসব ঘটনায় ৪০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। নারী অধিকার সংগঠন ‘নারীপক্ষ’ পর্যালোচনা করে দেখেছেÑ নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলাগুলোর খুব কমসংখ্যকের নিষ্পত্তি হয়েছে। তারা ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে করা, ছয়টি জেলায় চার হাজার ৩৭২টি ধর্ষণ মামলার অগ্রগতি বিশ্লেষণ করে দেখেছেনÑ মাত্র ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ মামলার বিচার হয়েছে, আর অপরাধী অভিযুক্ত হয়েছে আরো অনেক কম, মাত্র দশমিক ৩৭ শতাংশ।
এই তথ্য-উপাত্ত থেকে এটা স্পষ্ট করে বোঝা যায়, আমাদের ঘাটতিটা কোথায়। লঘু দণ্ডের কারণে এ দেশে বেপরোয়া গতিতে ধর্ষণ হচ্ছে, এমন একটা যুক্তিও সম্ভবত কেউ দেখাতে পারবে না। আইনের শাসনের ঘাটতি বা বর্তমানে চালু কথাটি হচ্ছেÑ বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে আমরা এমন অধঃপাতে যাচ্ছি। ধর্ষণের শিকার নারীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন না। আমাদের কাঠামো ধর্ষকদের পক্ষে চলে গেছে সবার অগোচরে। তাই আমরা বলব, আইনের শাসন ফিরিয়ে আনুন। অপরাধীদের বিরুদ্ধে দলীয় প্রভাবের ছায়া তুলে নিন। পুলিশ প্রশাসনকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন করে দিন। বিচারের গতিকে স্বাভাবিক করুন। তাহলে ধর্ষণের মহামারী বন্ধ হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement