১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
মানবাধিকার নিয়ে ব্রিটেনের উদ্বেগ

বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ হোক

-

বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ব্রিটেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর থেকে এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগের কথা জানানো হয়। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরেছে ব্রিটেন। দেশটির বিবৃতিতে নির্বাচনে ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও বিরোধী প্রার্থীদের ওপর আক্রমণের কথা বলা হয়েছে। একটি মানবাধিকার প্রতিবেদনে ৩০টি দেশের সাথে বাংলাদেশের চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের মানবাধিকার পর্যালোচনা করেছে লন্ডন। নির্বাচন নিয়ে সরকার দেশে যে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে সেটি সাধারণ একটা ঘটনা। বিবৃতিতে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১৫৮ জনের বিচারবহির্ভূত হত্যার পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দীর্ঘ দিন ধরেই নাজুক। নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অন্যায়ভাবে মানুষকে যাতে অব্যাহত হত্যা বন্ধ করে; সে জন্য নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সবার পক্ষ থেকে প্রতিবাদ হওয়া জরুরি।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো: রাশেদের হত্যা বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে নতুন এক চেতনার জন্ম দিয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ ও প্রতিকার নিয়ে একটা দিশা অন্তত পাওয়া গেছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ আমরা এ ধরনের ঘটনার পর শিক্ষা নেবো কি না। আপাতত দেখা যাচ্ছে, যারা বিচারবহির্ভূত হত্যা ঘটাচ্ছিলেন তারা এ ঘটনার পর নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। প্রদীপ লিয়াকত চক্র সিনহাকে হত্যা করে গত ৩১ জুলাই। ওই দিন পর্যন্ত ২০২০ সালে বাংলাদেশে ১৮৩ জন বন্দুকযুদ্ধের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন। জুলাই এবং আগের মাসগুলোতে আমরা যদি বিচারবহির্ভূত হত্যার চিত্র দেখি; তা হলে বোঝা যাবেÑ ক্রমবর্ধমান হারে বিচারবহির্র্ভূত হত্যা ঘটছিল দেশে। জুলাইয়ে সিনহাসহ ৪৭ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন। এর আগের ছয় মাসে ২১ থেকে ২৭ জন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন। গত জুলাইয়ে সেটা দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু একটি মৃত্যু এবং দেশব্যাপী মানুষের প্রতিবাদ বিচারবহির্ভূত হত্যার চিত্র পুরো বদলে দিয়েছে। আগস্টে মাত্র একজন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে এ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
বিচারবহির্র্ভূত হত্যার সংখ্যা শূন্যের কোটায় রাখতে প্রয়েজন সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিকতা। সরকার নিজের স্বার্থে মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়াকে যদি আশকারা না দেয়; তা হলে কোনোভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ চরম অন্যায় কাজ করার সাহস পাবে না। আপাতত সিনহা রাশেদের হত্যার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে অন্যরা এমন অবৈধ ও অমানবিক কর্মকাণ্ড করার সাহস পাচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, সিনহা হত্যার বিচার যদি না হয়; তা হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ বিচারবহির্ভূত হত্যা আবার লাগামহীন হয়ে উঠতে পারে। এ অন্যায় অশুভ প্রবণতা রুখতে এ হত্যার বিচার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাবেÑ ২০০৯ সালে বর্তমান জোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই হাজার ৪৭০ জন মানুষ, পুলিশ, র্যাব এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার হাতে বিচারবহির্র্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। এই ১০ বছরে নিরাপত্তা হেফাজতে থাকাবস্থায় ৬৯৫ ব্যক্তি মারা গেছেন। একই সময় নিখোঁজ হয়েছেন ৬০১ জন। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে নারী ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন ও হত্যার বহু ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দিকে তাকালে আমাদের কেবল হতাশ হতে হয়। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা পদোন্নতি পেয়েছেন, তাদের সুযোগ-সুবিধা কমেছে এমনটি জানা যায় না। অন্য দিকে ভুক্তভোগীরা অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করার স্বাধীন সুযোগও পাচ্ছেন না।
একটি রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া। বেআইনিভাবে মানুষ হত্যা যদি অব্যাহত চলতে থাকে; তখন রাষ্ট্রের কার্যকারিতা দুর্বল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, গণতন্ত্রকামী দেশ যখন মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বন্ধুদেশের সংশোধন চাইবেন তা হলে সেসব সংস্থা ও দেশকে প্রথমে মানুষ হত্যা নিয়ে কথা বলতে হবে। বেঁচে থাকলে মানুষ ভোট দিতে পারবেন এবং অন্য অধিকারেরও চর্চা করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সুতরাং আমরা আশা করব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে যে অভিযোগ এর অপনোদন হতে হবে। আর একজন মানুষও যেন অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর শিকার না হন সেই প্রত্যাশা আমাদের।


আরো সংবাদ



premium cement