২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`
তিস্তা শুকিয়ে জনজীবনে বিপর্যয়

পানি আগ্রাসন রুখতে হবে

-

‘করালগ্রাসী প্রমত্তা তিস্তা নদী বর্ষায় ফুলে-ফেঁপে দু’কূল ভাসিয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে থাকে। তিস্তা নদীর হিংস্র থাবা ভেঙে নিয়ে যায় ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও স্থাপনা। সেই তিস্তা নদী এখন শুকিয়ে ধু ধু বালুচরে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। খেয়া পারে বা মাছ ধরতে বর্ষায় নৌকা নিয়ে ছুটে চলা মাঝিমাল্লøাদের দৌড়ঝাঁপ নেই। পানি আর মাছে পরিপূর্ণ তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে শুধুই বালুচর।’
একটি সহযোগী দৈনিকের সচিত্র প্রতিবেদনের সূচনায় উল্লিøখিত বাক্য কয়টি থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছেÑ শুকনা মৌসুম আসার সাথে সাথে প্রমত্তা তিস্তার কী শীর্ণদশা দাঁড়িয়েছে। একই পত্রিকা আরো জানিয়েছে, তিস্তা নদীতে মাছ ধরতে না পেরে মানবেতর জীবন যাপন করছে বহু জেলে পরিবার। বিপন্ন হতে বসেছে নানা জীববৈচিত্র্য। হেঁটেই তিস্তা পাড়ি দিচ্ছে নদীর দু’পাড়ের মানুষ। তিস্তÍাপাড়ে চলছে হাহাকার। কৃষক ও জেলে থেকে শুরু করে তিস্তার সুবিধাভোগী লাখো মানুষের দুঃখের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে।
এ দিকে, লালমনিরহাটের মৎস্য অফিস জানিয়েছে, তিস্তার বাংলাদেশ অংশে ছিল ৩৭ প্রজাতির মাছ; কিন্তু নদীতে পানি না থাকায় সেসব মাছ বিলীয়মান। ফলে এখন মাত্র ৯টি প্রজাতির মাছ পাওয়া যাচ্ছে। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের মতে, তিস্তা নদীর জীববৈচিত্র্যের মধ্যে ৬৩টি প্রজাতির বেশির ভাগই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। রংপুর অঞ্চলে অন্য নদীগুলোতেও পানির সঙ্কট মরুকরণ তীব্র করে তুলছে। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ‘রিভারাইন পিপলস’ পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ এতে ঐকমত্য পোষণ করে বলেন, ‘‘তিস্তা ও অন্যান্য নদী ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে। হয়তো ‘নদী’র সাথেই পরিচয় ঘটবে না আগামী প্রজন্মের।’’ তিনি বলেন, তিস্তাসমেত অভিন্ন নদীগুলোর পানিসংক্রান্ত চুক্তি করা না গেলে কালের অতলে সব নদী হারিয়ে যাবে। এ নদী গবেষকের শঙ্কা, এ অঞ্চলে মরুকরণ ঘটবে। তিনি আরো বলেন, ‘ভারতের অংশে তিস্তায় যথেষ্ট পানি আছে। কিন্তু পড়শি দেশটি একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদী প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। এটা সুস্পষ্টভাবেই ভারত কর্তৃক আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে পানি পেতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ আইনি লড়াই করে হলেও তিস্তার ন্যায্য হিস্যা আদায় করে নিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’
উল্লেøখ্য, ভারতে হিমালয় সংলগ্ন সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেরার চিলমারী বন্দর হয়ে মিশেছে ব্রহ্মপুত্র নদে। তিস্তার মোট ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রবাহের মধ্যে ভাটির ১৬৫ কিলোমিটার অংশ রয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু উজানে জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবাতে বাঁধ দিয়ে ভারত তিস্তার পানি একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করায় বাংলাদেশের তিস্তা শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে এদেশের পাঁচটি জেলার ১৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ অংশে তিস্তার অববাহিকায় মানুষের জীবনযাত্রা এবং প্রকৃতির জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তদুপরি, বাংলাদেশের সুবৃহৎ তিস্তা সেচ প্রকল্পের ব্যারাজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
তিস্তা রেল সেতু ও সড়ক সেতু এবং নির্মাণাধীন তিস্তা সড়ক সেতু নদীটির বালুচরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ফলে ব্রিজ থাকলেও মানুষ হেঁটেই নদী পার হচ্ছে। নদীতে ঢেউ নেই, আছে শুধু বালু আর বালু। হাজারখানেক জেলে তিস্তÍার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তারা। নদীর মাঝিরাও আজ বেকার। তিস্তার বহু প্রাণী ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন সূত্র জানায়, তিস্তার অবশিষ্ট পানি ক্যানেলে নেয়ার পর নদীর বুকে শুধু বালুচরই থাকে। এতে মানুষের কষ্ট আজ চরমে।
আমরা মনে করি, দেশের সব অভিন্ন নদীতেই পানি আগ্রাসন অবিলম্বে রুখতে হবে। এ জন্য কূটনৈতিক চাপে কাজ না হলে আন্তর্জাতিক ফোরামের দ্বারস্থ হওয়া উচিত।


আরো সংবাদ



premium cement