২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
শক্তিধরদের ক্ষমতার দাপট

সাধারণ মানুষ অসহায়

-

দেশে এমন অবস্থা হয়েছে যে, কোনো মাত্রায় ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলেই কেউ কেউ ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবছেন। কিছু ব্যক্তি ক্ষমতা ও শক্তির দাপটে বেপরোয়াভাবে যা ইচ্ছা তা-ই করছেন। তারা এমন সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন, যাতে স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে দেশে আইনের শাসনের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এদের কাছে এখন আর কেউ নিরাপদ নন। সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সব শ্রেণিপেশার মানুষ এসব ‘ইচ্ছাপতির’ কাছে অনিরাপদ। আর সাধারণ মানুষ তো অসহায়। ক্ষেত্রবিশেষে সাধারণের জীবন হচ্ছে বিপন্ন।
রাষ্ট্রের ক্ষমতা যাদের কাছে আমানত হিসেবে অর্পিত, সাম্প্রতিক সময়ে তাদের অনেকের আমানত খেয়ানতের প্রবণতা লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়েছে। অতি সম্প্রতি সংঘটিত দু’টি ঘটনা এর প্রকৃষ্ট নমুনা। লোমহর্ষক প্রথম ঘটনাটি সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশের হেফাজতে একজন এএসআইয়ের নেতৃত্বে নির্যাতনে তরুণের মৃত্যু, যা সবার হৃদয়ে দাগ কেটেছে। যেখানে পুলিশ হেফাজতে সর্বোচ্চ নিরাপদ থাকার কথা, সেখানে উল্টো তরতাজা তরুণকে জীবন দিতে হলো। এই হত্যামামলার প্রধান আসামি পুলিশ কর্মকর্তা আকবর এখনো গ্রেফতার হননি। লক্ষণীয় বিষয়, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ইদানীং বেড়ে গেছে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় তুলেছে। যিনি এ ঘটনার হোতা তার বাবা এবং শ্বশুর দু’জনই সংসদ সদস্য। নিজে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর। ক্ষমতা আর অর্থের দম্ভে কাউকে সম্ভবত মানুষ ভাবতেন না তিনি। নিজের বাড়িটি পরিণত করেছিলেন রীতিমতো দুর্ভেদ্য দুর্গে। সেখানে পাওয়া গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার করে এমন ওয়াকিটকি, হ্যান্ডকাফ, ফ্রিকোয়েন্সি ডিভাইস। মানুষকে ধরে এনে নির্যাতনের জন্য গড়ে তুলেছিলেন টর্চার সেল। তিনি ঢাকা-৭ আসনের এমপি হাজী সেলিমপুত্র এরফান সেলিম।
খবরে প্রকশ, ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের এ কাউন্সিলর গত রোববার রাতে সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো গাড়িতে দেহরক্ষী নিয়ে বের হয়েছিলেন ধানমন্ডি এলাকায়। গাড়িটি বেপরোয়াভাবে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমেদ খানের মোটরসাইকেলে। স্ত্রীকে নিয়ে ব্যক্তিগত কাজে বের হওয়া ওই কর্মকর্তা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন মাত্র। এরপর আর তার রক্ষা হয়নি। গাড়ি থেকে নেমে ওই কর্মকর্তার ওপর হামলে পড়েন এরফান ও তার দেহরক্ষীরা। রক্তাক্ত অবস্থায় নিজের পরিচয় দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিলেন তিনি। ঘটনাস্থলে ধারণ করা একটি ভিডিও চিত্র ভাইরাল হলে নিন্দার ঝড় ওঠে সর্বত্র। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর অভিযানে নামে র্যাব। আটক করা হয় এরফানকে। হাজী সেলিমের পৈতৃক বাড়িতে অভিযানকালে খোঁজ মেলে এরফানের অবৈধ সাম্রাজ্যের। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষমতার অবৈধ দাপটে এরফান এমন সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তার দম্ভ আর ক্ষমতার দাপটে অতিষ্ঠ ছিলেন এলাকার মানুষ। এরফানকে মাদক সেবনের দায়ে এক বছর ও অবৈধ ওয়াকিটকি রাখার দায়ে ছয় মাসের দণ্ড দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। দেহরক্ষীকে অবৈধ ওয়াকিটকি রাখার দায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, স্বেচ্ছাচারী ও ‘ইচ্ছাপতিরা’ তখন পর্যন্ত নিরাপদ থাকছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা কোনো মর্যাদাবানের ওপর হামলে পড়ছেন। শুধু তখনই তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে; বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা পোর্টফোলিওধারী কেউ তাদের দ্বারা আক্রান্ত হলে। এর আগে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন, বহু অপকর্মের হোতা কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ যখন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে হত্যার দায়ে জড়িয়ে পড়েন, কেবল তখনই প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল হাজী সেলিমপুত্র এরফানের ক্ষেত্রেও। অথচ তার নেতৃত্বে দীর্ঘ দিন ধরে সাধারণ মানুষ নিগৃহীত হয়েছেন। তাতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কোনো টনক নড়েনি।
আমাদের সংবিধানে সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। বাস্তবে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সাংবিধানিক সেই অধিকার কতটুকু সুরক্ষিত হচ্ছে; সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকছে। দেখা যাচ্ছে, কেবল সবলের জন্য আইনি সুরক্ষা ত্বরিত কাজ করছে, সাধারণের বেলায় তার ব্যত্যয় ঘটছে। এভাবে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে আইনের শাসনের মজবুত ভিত পাওয়া দুরাশা ছাড়া আর কিছু নয়। অবৈধ ক্ষমতার দাপট নিয়ন্ত্রণে সবার ক্ষেত্রে আইনের সমপ্রয়োগ হতে হবে। কেবল তখনই দেশে সুশাসন আশা করা যায়।

 


আরো সংবাদ



premium cement