২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`
পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু

ন্যায় বিচারের জন্য হুমকি

-

দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েই চলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে এনকাউন্টার বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এবং পুলিশি হেফাজতে আটক ব্যক্তিকে নির্যাতন করে ইতোমধ্যে বহু মানুষের প্রাণ হরণ করা হয়েছে। হরহামেসাই এমন ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে সিলেট মহানগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে। এর শিকার তরতাজা এক তরুণ। তাকে পুলিশি হেফাজতে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে নিহতের স্বজনের দাবি। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, দেশে এ ধরনের হত্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কিছু সদস্যের অপরাধপ্রবণতাই দায়ী। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ এ নিয়ে উদ্বিগ্ন কি না সে প্রশ্ন থেকেই যায়। অথচ সবারই জানা, এমন হত্যাকাণ্ড আমাদের বিচারব্যবস্থার জন্য হুমকি। এতে যে প্রচলিত বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে; সেই বোধও যেন দেশ পরিচালনায় যারা রয়েছেন তারা হারাতে বসেছেন। দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে বলা আছে, যেকোনো নাগরিকের বিচার পাওয়ার অধিকার তার সাংবিধানিক অধিকার। নাগরিকদের এই অধিকার উপেক্ষিত হলেও যেন সরকারের ভ্রƒক্ষেপ নেই।
আমাদের দেশে আসামিকে ‘রিমান্ডে’ নিয়ে নির্যাতন করার অভিযোগও দীর্ঘ দিনের। যদিও কাগজে-কলমে ‘জিজ্ঞাসাবাদে’র কথা আদালতকে জানানো হয়, বাস্তবে কী ঘটে তা অনুমান করা কষ্ট সাধ্য নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, গ্রেফতার বা আটক ব্যক্তি জিজ্ঞাসাবাদের নামে তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করেন। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ-পরবর্তী আদালতে উপস্থিত করার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ‘বিধ্বস্ত’ চেহারাই বলে দেয় তার সাথে কী আচরণ করা হয়েছে। রিমান্ড শেষে হাসপাতালেও যেতে হয় অনেককে। নিঃসন্দেহে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ভয়াবহ। এসব ক্ষেত্রে পুলিশের দিক থেকে যদিও ‘হার্ট অ্যাটাক’ জাতীয় আকস্মিক মৃত্যুর কারণ দেখানো হয়, ওই ব্যক্তির স্বজনদের ভাষ্য থাকে ভিন্ন। সিলেটে আমরা তারই পুনরাবৃত্তি দেখলাম আরো নৃশংস কায়দায়।
সিলেটে রায়হান আহমেদ যেভাবে নিহত হয়েছেন, এর দায় সেখানকার পুলিশের বন্দরবাজার ফাঁড়ি এবং সার্বিকভাবে পুলিশ বাহিনী এড়াতে পারে না। রায়হানকে জীবিত অবস্থায় আটক এবং পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় যা ঘটেছে, তাতে করে ওই ফাঁড়ির সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের অপরাধমনস্কতা স্পষ্ট। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, প্রথমে মৃত্যুর ঘটনাকে পুলিশের পক্ষে ‘ছিনতাই পরবর্তী গণপিটুনির শিকার’ হিসেবে চালানোর অপচেষ্টা করা হয়। যে এলাকা ঘিরে ছিনতাই ও গণপিটুনির ‘গল্প’ ফাঁদা হয়, সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজে এ ধরনের কোনো চিত্র পাওয়া যায়নি। বাস্তবতা হলো, রায়হানের মৃত্যু পুলিশি নির্যাতনেই ঘটেছে। লাশেও ছিল নির্যাতনের চিহ্ন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলের প্রাথমিক তদন্তে তা স্পষ্ট। বন্দরবাজার ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপরিদর্শকসহ সেখানে দায়িত্বরত চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত ও আরো তিনজনকে প্রত্যাহার করায় ছিনতাই ও গণপিটুনির গল্প বাতিল হয়ে যায়। এখন দেখার বিষয় নিষ্ঠুর এই ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হয়েছে এবং জড়িতদের দেয়া হয়েছে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। কোনো মানুষের জীবনের যথার্থ ক্ষতিপূরণ দেয়া সম্ভব নয়; তবু রায়হানের পরিবার যাতে বিচার ও ক্ষতিপূরণ পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই।
২০১৩ সালে প্রণীত হয়েছিল ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’। তারও আগে ১৯৯৮ সালে পুলিশি হেফাজতে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামীম রেজা রুবেল প্রাণ হারানোর পর এ নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। মানবাধিকার সংস্থা ব্লাস্টের পক্ষে তখন রিমান্ডে নির্যাতনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থে রিট করা হয়েছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তারপরও পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু থেমে নেই। তার মানে, পুলিশের কিছু সদস্য এতটাই বেপরোয়া হয়েছে যে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে যে, দেশে গত সংসদ নির্বাচনে পুলিশকে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী বৈতরণী পেরুতে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তার ফলে এই বাহিনীর কোনো সদস্য যদি ভাবেন আমরা যা কিছু করি না কেন, সরকারের তরফ থেকে কিছু বলার নেই, তাহলে কি-ই বা বলার থাকে! কিন্তু কথা হলো, এভাবে প্রজাতন্ত্রের নাগরিকরা তাদেরই অর্থে প্রতিপালিত পুলিশের হাতে প্রাণ দিতে পারেন না। বিষয়টি নিছক পুলিশের ভাবমূর্তি বা নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন নয়, বরং আইনের শাসনের গোড়ার কথা।


আরো সংবাদ



premium cement