২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`
টেকনাফে অব: মেজরের অনাকাক্সিক্ষত হত্যা

তদন্ত ও বিচার দ্রুত সম্পন্ন হোক

-

কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার ঘটনা দৃশ্যত অনাকাক্সিক্ষত। এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও তদন্ত শেষে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন। তবে স্পর্শকাতর এই বিষয়টি নিয়ে কোনো রকম কালক্ষেপণের সুযোগ নেই মোটেও। আইনশৃঙ্খলা এবং দেশরক্ষা বাহিনীর মধ্যে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলার যে ঐতিহ্য বহু যুগ ধরে চলে আসছে এ ঘটনায় সেটি গুরুতরভাবে ক্ষুণœ হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত করে এ ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযোগ্য আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমেই উদ্ভূত পরিস্থিতির স্বাভাবিক অবসান হতে পারে।
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে এসেছে। আদতেই পুলিশ ‘আত্মরক্ষার্থে’ গুলি চালিয়েছিল কি না সেটি সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ঘটনার যে বিবরণ পুলিশ দিয়েছে তা প্রতিটি ক্রসফায়ারের ঘটনায় দেয়া তাদের গৎবাঁধা বুলির মতোই। সুতরাং সিনহা সত্যিই পুলিশের প্রতি পিস্তল তাক করেছিলেন, নাকি ওসির প্ররোচনায় এসআই ঠাণ্ডামাথায় গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করেছেন সেটি অন্যতম প্রধান প্রশ্ন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল টিআইবি, পুলিশের মামলার এজাহার ও সেনাবাহিনীর প্রাথমিক তদন্তের বক্তব্যে সৃষ্ট বৈপরীত্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বিষয়গুলো আমলে নিতে বলেছে। নিহতের সঙ্গী শিক্ষার্থী ও অন্যসব সম্ভাব্য সাক্ষীর নিরাপত্তাসহ সব অধিকার নিশ্চিত করার প্রয়োজনের কথাও বলেছে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের জন্য সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
সেনাবাহিনী প্রধান এ ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু টিআইবি বলছে, এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই, বরং তা বিচারবহির্ভূত হত্যার অপসংস্কৃতিকে স্বাভাবিকতায় রূপান্তরের একটি নজির মাত্র। এই বক্তব্যের পক্ষে টিআইবি গণমাধ্যমের খবরের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে সারা দেশে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সাথে শতাধিক ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৮৭ জন। দেশের সব নাগরিকের আইনি সুরক্ষা পাওয়ার যে অধিকার সংবিধান দিয়েছে, নিহতরা সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত। নিহতদের সবাই মাদকের ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। চাঁদা না দেয়ায় মানুষকে ‘ক্রসফায়ারে দেয়ার’ মতো অভিযোগও কম নয়। তাই মেজর সিনহার ঘটনাটি এই চলমান পরিস্থিতিরই অংশ।
এ ঘটনায় আদালতে হত্যা মামলা করেছে মেজর সিনহার পরিবার। মামলার এজাহারে ঘটনার যে বিবরণ দেয়া হয়েছে তাতে মনে হবে, পুরো ঘটনাটি পুলিশের শক্তি প্রদর্শনের একটি মহড়া ছিল। সেনাবাহিনীর একজন মেজরকে তারা থোড়াই কেয়ার করেনÑ এটি দেখানোর একটি প্রবণতা যেন কাজ করেছে এই নৃশংস ও মর্মান্তিক ঘটনায়। আমরা গণমাধ্যমের নানা রিপোর্ট থেকে জানি, কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়ক ‘ক্রসফায়ারের’ নিরাপদ এলাকা হিসেবে পরিচিত। গত দুই বছরে শুধু মেরিন ড্রাইভেই অর্ধশতাধিক ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেছে। কিছু অসৎ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত ‘মাসোহারা’ আদায়ের মারাত্মক অভিযোগ ছিল। অবৈধ উপার্জনের পথ হিসেবে গ্রেফতার বাণিজ্যের অভিযোগও বেশুমার। তা ছাড়া, টেকনাফ থানার বহুল আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ যে ট্রিগার-হ্যাপি শুটারে পরিণত হয়েছিলেন তা তার অতীতের কর্মকাণ্ড থেকে ধারণা করা অসঙ্গত হবে না। বছর দুয়েক আগে তিনি টেকনাফ থানায় যোগ দেন। এই দুই বছরে দেড় শতাধিক ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ঘটেছে এ থানা এলাকায়। এমনকি বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসে বন্দুকযুদ্ধের কাহিনী সাজিয়ে রাজনৈতিক কর্মীকে মেরে ফেলার গুরুতর অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
এখন মামলার সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে যা যা করণীয় সেগুলো যথাযথভাবে করে আইনকে নিজের মতো চলতে দেয়া প্রত্যাশিত। তা না হলে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে স্বাভাবিক সম্প্রীতির সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের আশা কখনোই পূরণ হবে না। আর সেটি না হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধেরও নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে না। সেনা ও পুলিশ প্রধান এই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির ওপর আস্থা প্রকাশ করেছেন। তাই কমিটির কাছে পক্ষপাতহীন তদন্তের আশা করাই যায়। দ্রুত এ ঘটনার তদন্ত ও বিচারের কাজ সম্পন্ন করা হবে দেশবাসীর এটাই প্রত্যাশিত।


আরো সংবাদ



premium cement