২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`
মহাপরিচালকের বিদায় যথেষ্ট নয়

অবিলম্বে তদন্ত দরকার

-

অবশেষে পদত্যাগ করে বিদায় নিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: আবুল কালাম আজাদ। স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম নিয়ে তীব্র বিতর্কের মধ্যে গত মঙ্গলবার তিনি পদত্যাগ করেন। কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতি মোকাবেলায় সার্বিক ব্যর্থতার দায় মাথায় নিতে হলো তাকে। এ জন্য দায়ী তার একটি ভুল মন্তব্যও। ‘মহামারী দীর্ঘমেয়াদে চলতে পারে’ বলে তিনি যে মন্তব্য করেছিলেন তা সরকারের মধ্যে তাকে বিতর্কিত করেছে এবং সর্বশেষ কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে অধিদফতর থেকে অনুমোদন পাওয়া রিজেন্ট হাসপাতাল এবং নমুনা সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান জেকেজির নজিরবিহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ও প্রতারণার বিষয়। এ নিয়ে দেশজুড়ে যখন তীব্র সমালোচনা চলছে তখন স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে চুক্তিটি করা হয়েছিল।’ মূলত এই বক্তব্যই তার বিদায়ের ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজেদের পিঠ বাঁচাতেই তাকে টার্গেট করেন। মন্ত্রণালয় থেকে অধিদফতরের মহাপরিচালককে শোকজ করা হয়। মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সচিবের কাছে শোকজের লিখিত জবাবও দেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি; কিন্তু তাতে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কাজে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ শুরু থেকেই ছিল। করোনা সংক্রমণ রোধে সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা করোনা মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ যথেষ্ট ছিল না বলে শুরু থেকেই বলে আসছিলেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার অভিযোগ অনেক পুরনো। করোনা মহামারীর সময় এসব অভিযোগ আরো বড় আকারে দেখা দেয়। স্পষ্ট হয়ে ওঠে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের অদক্ষতা, ব্যর্থতা। জেকেজি ও রিজেন্টের দুর্নীতি প্রকাশ পেলে মানুষ হতভম্ব হয়ে পড়ে। দেশের পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার নাজুক চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে যায় যখন করোনার টেস্টের জন্য হাজার হাজার মানুষকে লাইন দিয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকতে হয়। ভেন্টিলেশনের অভাবে একের পর এক হাসপাতালে ঘুরেও চিকিৎসা না পেয়ে সরকারের প্রভাবশালী আমলা, ডাক্তার, বিশিষ্ট নাগরিকদের মৃত্যুবরণ করতে হয়। মানুষ অসহায়ভাবে দেখতে পায় সরকারের একাধিক সাবেক মন্ত্রী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। পুরো স্বাস্থ্য খাতের লেজেগোবরে অবস্থা মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অনেকেই মনে করেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জড়িত না থাকলে করোনা রোধের এই সময়ে অবিশ্বাস্য মাত্রায় দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া সম্ভব ছিল না। এমনকি নকল ও নিম্নমানের মাস্ক, কিট ও পিপিই আমদানির সাথে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার পরিবর্তে যারা নকল মাল নিতে আপত্তি করেছেন, এমন চারজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়ে বিশ্বে ‘অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করা হয়। এতে স্পষ্টতই অনুধাবন করা যায়, দুর্নীতির সাথে স্বাস্থ্য বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা আছে। তা না হলে উল্টো ব্যবস্থা গ্রহণের অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে না। মহামারী মোকাবেলার জন্য যে ধরনের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ঘোষণা করে অন্যান্য দেশের সরকার নেতৃত্ব দিয়েছে, বাংলাদেশে তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। মনে হয়েছে, কোনোরকম উদ্যোগ না নিয়েই হাল ছেড়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরা। রোগ শনাক্তকরণ, চিকিৎসা, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিনÑ সব ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার ছাপ ছিল স্পষ্ট। নন-কোভিড রোগীরা হাসপাতালে চিকিৎসা পাচ্ছেন না, অথচ কোভিড হাসপাতালে ৭২ শতাংশ শয্যা খালি। এসব ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতর কখনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়নি।
দীর্ঘ ছয় মাসের করোনাকালে স্বাস্থ্য বিভাগে কোনোরকম জবাবদিহির ব্যবস্থা আছে বলে মনে হয়নি। এখন ডিজিকে ‘বলির পাঁঠা’ করে অন্যরা পার পেয়ে যাওয়ার রাস্তা বের করা হয়েছে। আমরা মনে করি, ডিজির পদত্যাগ যথেষ্ট নয়। পুরো স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডের ওপর সমন্বিত তদন্ত হওয়া দরকার। যেসব অভিযোগ শুরু থেকে উঠেছে সেসব বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক কর্মকর্তার ভূমিকা খতিয়ে দেখে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তাতে যদি অকর্মণ্য ও দুর্নীতিগ্রস্তদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হয় সেটিই করতে হবে। এর অন্য কোনো বিকল্প নেই।

 


আরো সংবাদ



premium cement