২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
করোনাকালেও বড় দুর্নীতির ছক

‘কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না’

-

একটি জাতীয় দৈনিকের লিড নিউজ : মহামারীর এই মহাদুর্যোগের সময়েও মহাদুর্নীতির মহা পরিকল্পনা ধরা পড়েছে। গরিবের টাকা মেরে খাওয়ার এমন বিরাট উদ্যোগ আয়োজনের কথা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চিন্তায়ও আসেনি। দেশের অর্ধকোটি প্রান্তিক তথা নির্বিত্ত মানুষের জন্য সরকারের নগদ অর্থসহায়তা দিতে গিয়ে তারা এই অভাবনীয় দুর্নীতির নীলনকশা উদঘাটন করেছেন।
জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে যে তালিকা মাঠপর্যায় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, এতে ৫০ লাখ মানুষের মধ্যে ২৮ লাখের ব্যাপারেই তথ্যের গরমিল ধরা পড়েছে। ‘জনপ্রতিনিধি’ হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিদের প্রণীত ও প্রেরিত ওই তালিকায় হতদরিদ্র-ছিন্নমূল মানুষের জায়গায় কিভাবে সরকারি কর্মচারী, সঞ্চয়পত্রের মালিক, পেনশনভোগী প্রমুখের নাম অনুপ্রবেশ করল, এটি এক বিরাট প্রশ্ন। ঊর্ধ্বতন মহল মনে করে, ‘এটি নেহায়েত ভুলবশত হয়নি; বরঞ্চ ইচ্ছা করেই তা করা হয়েছে।’ এভাবে একটি প্রভাবশালী মহল ৬৯৫ কোটি টাকা মেরে দেয়ার পাঁয়তারা করেছে বলে অভিযোগ। মন্ত্রণালয়ের গোপন রিপোর্টে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে চলছে নভেল করোনাভাইরাসরূপী ভয়াবহ জীবাণুর ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ। এই নজিরবিহীন মহামারীর অবাধ তাণ্ডবের সাত মাস চললেও এর প্রাদুর্ভাব কমার কোনো লক্ষণ আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। এতে বাংলাদেশে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অসংখ্য খেটেখাওয়া নিম্নবিত্ত ও ছিন্নমূল নাগরিক। ইতোমধ্যেই আয় রোজগার হারিয়ে বেকার হয়ে গেছেন অন্তত দুই কোটি মানুষ। করোনাকালের বিষম দুঃসময়েই কিছু দিন আগে ঈদুল ফিতর পালিত হয়েছে। দেশের মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ এ উৎসব উপলক্ষে ৫০ লাখ প্রান্তিকজনের জন্য সরকার মাথাপিছু আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। এ জন্য মোট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১,২৫০ কোটি টাকা। ১৪ মে এ গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিটি উদ্বোধন করা হলেও তাড়াহুড়োর মধ্যে ১৬ লাখ ১৬ হাজার ৩৫৬ জনকে টাকা দেয়ার পরপরই তা স্থগিত করা হয়। তালিকার বাকি প্রায় ৩৪ লাখ এবং ‘সংশোধিত’ তালিকার অতিরিক্ত আট লাখেরও বেশি মানুষকে আসন্ন ঈদুল আজহার আগেই টাকা পাঠানোর কথা। লক্ষণীয় হলো, যাদের নগদ সহায়তা দেয়া হয়েছে, সেই ১৬ লাখ মানুষ সংক্রান্ত তথ্য ঠিক আছে কি না, তা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় মুখ খোলেনি। তবে এই কর্মসূচির দুর্নীতি ও অনিয়মের খবর এরই মধ্যে ফাঁস হয়ে গেছে।
সাবেক অর্থপ্রতিমন্ত্রী ও বর্তমানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘মনে হয় তালিকায় বহু ভুল রয়েছে। তবে স্বস্তির কথা হলো, টাকাটা ওদের কাছে চলে যায়নি। এখন ভুল শুধরে টাকাটা দিয়ে দিতে হবে। আমলাতান্ত্রিক কিংবা অন্য কোনো কারণে এ উদ্যোগ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমার নিজের এলাকার কেউ বলেছেন, ‘টাকা পেয়েছি।’ কেউ বলেন, ‘ভুল আছে। তা ঠিক করে দেবে।’
এ দিকে জানা যায়, জালিয়াতি ধরা পড়ায় পাঁচ লাখের তালিকা বাতিল হয়ে গেছে। জেলা-উপজেলা প্রশাসন থেকে মন্ত্রণালয়ে এসব তালিকা এসেছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আলোচ্য প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা স্মার্ট কার্ডের বিপরীতে নিবন্ধনহীন মোবাইল নম্বর দেয়া হয়েছে আট লাখ ২৯ হাজার ৯৪৮ জনের ক্ষেত্রে। তদুপরি এ তালিকায় ‘পেশা’ হিসেবে গৃহিণী, বস্তিবাসী, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা প্রভৃতি উল্লেখ করা হয়। মোট ২২ লাখ ৮৬ হাজার ৫২৮ জনের তথ্যে গরমিল পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট অর্থের পরিমাণ ৫৭১ কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার টাকা।
এই দুর্নীতি প্রসঙ্গে একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘সরকার তালিকা বানাতে দিলে মেম্বার ও চেয়ারম্যানরা সেখান থেকে কিছু টাকা বাগিয়ে নেন। আর সরকারও চায়, তাদের কাছে কিছু আসুক।’ তার মতে, বরং উচিত ছিল, ‘সাহায্য প্রাপকদের নিজের পরিচয় নিজেই নিশ্চিত করা। ভুল তথ্য দিলে কয়েক হাজার টাকা জরিমানা করা যেত।’
সম্প্রতি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনে কারো কারো অভিমত ছিল, ‘আমরা এই করোনা মহামারী থেকেও কোনো শিক্ষা নেবো না। অতএব, আগামী দিনেও সব কিছু আগের মতো চলবে।’ একজন বিশিষ্ট সংস্কৃতিসেবী বলেছেন, ‘এতব ড় দুর্যোগের বিষয়ও আমরা ভবিষ্যতে ভুলে যাবো।’ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ইতোমধ্যেই এসব লক্ষণ প্রকট হয়ে উঠছে।
কয়লা ধুলেও নাকি ময়লা যায় না। আমরা আর কত দিন কয়লাতুল্য ময়লা মানুষদের জাতির ভাগ্য আর দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেবো?

 


আরো সংবাদ



premium cement