২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
করোনাকালে বেড়েছে বাড়িতে প্রসব

অনিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য

-

যেকোনো রোগের প্রাদুর্ভাবই ব্যক্তি, সমাজ এবং কাঠামোর ওপর প্রভাব ফেলে। দেশে করোনাকালে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেভাবে ‘ব্যাহত’ হচ্ছে, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যও এর বাইরে নয়। বাংলাদেশের হাজারো নারীর দেশের ‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতিতেই প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক নানাবিধ সঙ্কটে থাকেন, বিশেষ করে যারা শহরের বস্তি এলাকা ও গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন। মহামারীর বিরূপ প্রভাব পড়ছে দেশের মাতৃস্বাস্থ্যের ওপর। গর্ভ কিংবা প্রসবকালীন জটিলতাগুলো এবং অত্যাবশ্যকীয় নবজাতকের সেবা যেহেতু অত্যন্ত সময়-সংবেদনশীল, সময়মতো এ সেবা নিশ্চিত করা না গেলে প্রসূতি এবং সন্তান, দু’জনেরই ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। সেই নাজুক পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়েছে দেশের মাতৃস্বাস্থ্য। করোনা মহামারী দেশে ‘নিরাপদ মাতৃত্ব’কে নিরাপদ না করে, বাড়তি ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। করোনার আতঙ্কে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। অনেক হাসপাতাল থেকে অসংক্রমিত রোগে আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ রোগীও ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে বেশুমার। ফলে প্রসূতিরাও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বেশির ভাগ সময়ই বঞ্চিত হচ্ছেন।
করোনা মহামারীর আকস্মিক আবির্ভাব বাংলাদেশের মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা ও সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে। গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন রকমের হরমোন নিঃসরণ হওয়ায় নারীদের শারীরিক অবস্থা পরিবর্তিত হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং পুরো শরীর ভীষণরকম নাজুক অবস্থায় থাকে। ফলে গর্ভবতী মায়েদের নিয়মিত সেবার প্রয়োজন হয়। গর্ভাবস্থার মতো আরেকটি জরুরি বিষয় হলো সদ্যপ্রসূত মায়েদের প্রসবোত্তর সেবা। কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দেশের স্বাস্থ্য খাত বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ায় মাতৃস্বাস্থ্যের সেবা গ্রহণের সুযোগ সঙ্কোচিত হয়ে পড়েছে। মহামারীর এই সময়ে গর্ভকালীন সেবা নিতে না পারা, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে না পারা, জরুরি ওষুধপত্র সংগ্রহ ও গ্রহণ করতে না পারার কারণে গর্ভাবস্থা ও প্রসবোত্তরকালে নারী ও নবজাতকের স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
সরকারি এক জরিপ মতে, দেশে প্রজননক্ষম বয়সে (১৫-৪৯) নারীদের যে মৃত্যু হয়, তার ১৩ শতাংশই ঘটে সন্তান জন্ম দেয়ার সময়। মহামারীর কারণে মাতৃস্বাস্থ্য আরো নাজুক হয়ে পড়ায় মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনিতেই দেশে প্রতি বছর ৪৭ শতাংশ প্রসূতি অর্থাৎ প্রায় ১৭ লাখ মা এখনো অদক্ষ পরিচর্যাকারীর হাতে সন্তান জন্ম দেন। এ মায়েরা এবং তাদের নবজাতকরা থাকেন ঝুঁকিতে। এই হার বেড়ে গেছে। খবর থেকে জানা যায়, ‘দেশে প্রসব-পূর্ব ও প্রসব-পরবর্তী সেবা কমে গেছে। বাড়িতে প্রসব বেড়েছে ২৩ শতাংশ। গত বছর মার্চে একবার প্রসব-পূর্ব সেবা পাওয়া গর্ভবতী ছিলেন ৪২ হাজার ৫২৬ জন, এ বছর মার্চে সেই সংখ্যা কমে হয় ২৬ হাজার ৪১৫। পরিস্থিতির আরো অবনতি হয় এপ্রিলে। গত বছর এপ্রিলে একবার প্রসব-পূর্ব সেবা পেয়েছিলেন ৪২ হাজার ৫৭১ জন গর্ভবতী। এ বছর পেয়েছেন মাত্র ১৮ হাজার ৬২ জন।’
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জন করার ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা হচ্ছে আপৎকালীন স্বাস্থ্যসেবার অভাবনীয় খরচ। আমরা একটা বহুমাত্রিক দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কায় আছি। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষ প্রবল অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়তে শুরু করেছেন। এই শ্রেণীর মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে এই অর্থসঙ্কট আরো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মানুষ স্বাস্থ্যসেবার প্রায় ৭০ শতাংশ খরচ নিজের পকেট থেকে করেন, যা বিশ্বে সর্বোচ্চদের দলে। জাতি হিসেবে আমাদের স্বপ্ন, ২০৩০-এর মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে এ রকম দিকনির্দেশনাহীন, জবাবদিহিবিহীন স্বাস্থ্য খাত খুবই বেমানান।
আমরা মনে করি, করোনাকালে দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের হাসপাতাল মাতৃস্বাস্থ্য সেবা বাড়াতে প্রসূতি ও নবজাতকের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যেসব হাসপাতাল সেবা দিতে গড়িমসি করবে, সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোনো কার্পণ্য করা যাবে না। আর মাতৃস্বাস্থ্যের ওপর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের, রোগী দেখতে চেম্বারে নিয়মিত বসতে হবে। এ জন্য কর্তৃপক্ষকে চিকিৎসকদের মানসম্পন্ন পিপিই সরবরাহ করতে হবে। মাতৃস্বাস্থ্যসেবা অব্যাহত রাখতে হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের আন্তরিক হতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement