১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
বাসভাড়া বাড়ল ৬০ শতাংশ!

এ সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ গণবিরোধী

-

বাস-মিনিবাসের ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়িয়ে দিলো সরকার। গত রোববার এই সিদ্ধান্ত জানান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিশ্বের আর কোথাও কখনো কোনো কারণে গণপরিবহনের ভাড়া এই পরিমাণে বাড়ানোর কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে দিক থেকে এটি নিঃসন্দেহে একটি বিশ্বরেকর্ড।
করোনা সঙ্কটের কারণে দুই মাসের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর গতকাল সোমবার সীমিত পরিসরে গণপরিবহন তথা বাস, ট্রেন ও লঞ্চ চালু হয়েছে। রোববার ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। যাদের নিজস্ব পরিবহন নেই, সেই গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য গণপরিবহনই ভরসা। বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাসে যাতে যাত্রীদের গায়ে গায়ে লেগে বসতে বা দাঁড়াতে না হয় সে জন্য অর্ধেক আসন খালি রাখতে হবে। এর ফলে যাত্রীস্বল্পতা নিয়ে বাস চালাতে গেলে আর্থিক ক্ষতি হবে মালিকদের। তাই ভাড়া শতভাগ বাড়িয়ে সে ক্ষতি পুষিয়ে দিতে হবে। মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) গত শনিবার ঢাকা ও সারা দেশে বাস-মিনিবাসের ভাড়া নজিরবিহীনভাবে ৮০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরি করে। নানা মহল থেকে ওই প্রস্তাবের সমালোচনা শুরু হলে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ভাড়ার হার ৬০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেন। এর সাথে দূরের যাত্রায় সেতু ও সড়কের টোল ইত্যাদিও ভাড়ার সাথে যুক্ত হবে।
কিন্তু করোনার কারণে শুধু কি বাস মালিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন? লঞ্চ-স্টিমারের মালিকরা ক্ষতির শিকার হননি? তারা তো সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য ভাড়া বাড়ানোর আবদার করেননি! তাহলে বাস মালিকদের এই দাবি কেন? করোনায় লকডাউনে প্রায় তিন মাস ধরে সব শ্রেণীর মানুষকেই কার্যত গৃহবন্দী থাকতে হয়েছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ কাজ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। অনেকে পুঁজি ভেঙে খেয়েছেন। বিপুল মানুষ ধার-দেনায় তলিয়ে গেছেন। আমাদের দেশে এখনো এ ধরনের নিম্ন আয়ের মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ। শতকরা ৬০ ভাগ ভাড়া বাড়ানোর ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ এসব নিঃস্ব মানুষের ওপর কতটা চাপ পড়বে সড়কমন্ত্রী সেটি বিবেচনায় নিয়েছেন বলে মনে হয় না।
যাত্রীকল্যাণ সমিতি ও কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কর্মকর্তারা বলেছেন, বাসভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। দীর্ঘ দিন আয়-রোজগার না থাকায় গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ খুবই দুরবস্থার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে ধারকর্জ করে কোনো মতে সংসার চালাচ্ছেন। এই মুহূর্তে বর্ধিত বাসভাড়া তাদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দেবে। যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলেছে, পরিবহন খাতে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়, সেটি বন্ধ করলে যাত্রীদের ওপর বাড়তি ভাড়া চাপানোর প্রয়োজন পড়ত না। বিশ্ববাজারে অনেক আগেই তেলের দাম একেবারে কমে গেছে। দেশে দীর্ঘ দিন কম মূল্যে জ্বালানি তেল কিনে চড়া দামে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করেছে সরকার। কিন্তু জনগণকে সেই সুবিধার বিন্দুমাত্রও ভাগ দেয়নি। তেল, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের দাম এক পয়সাও কমায়নি; বরং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণে বাড়িয়েছে। তেলের দাম কমানো এবং গণপরিবহনে বেআইনি চাঁদাবাজি বন্ধ করলে যাত্রীদের আর ভোগান্তির মধ্যে ফেলতে হতো না।
সরকার গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পের জন্য আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছে। পরিবহন মালিকদের জন্যও সে রকম কোনো ব্যবস্থা করতে পারত। কিন্তু চাঁদাবাজি বন্ধ বা প্রণোদনা দেয়ার কোনো দিকেই যাননি সেতুমন্ত্রী। তিনি যাত্রীসাধারণের ওপর তা চাপিয়ে দেয়ার সহজ পথই বেছে নিয়েছেন। এটিই সহজ পথ, কারণ ক্ষমতায় আসতে এবং সরকারে থাকতে তাদের এখন আর জনগণকে তোয়াক্কা করার দরকার পড়ে না।
আমরা অতীতে দেখেছি, সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়, মালিকরা তার চেয়ে ১০-২০ শতাংশ বেশি ভাড়া আদায় করে যাত্রীদের কাছ থেকে। যেমন, সরকার ছোট বাসের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ভাড়া পাঁচ আর বড় বাসের ক্ষেত্রে সাত টাকা ঠিক করে দিলেও বাসে উঠলেই কোথাও সর্বনিম্ন দিতে হয় ১০, কোথাও ১৫, কোথাওবা ২০ টাকা। এবার ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর কারণে বাস্তবে তা ১০০ ভাগেই দাঁড়াতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করি। সুতরাং এই হারে ভাড়া বাড়ানো শুধু যে অযৌক্তিক তা নয়; বরং এ সিদ্ধান্ত যেকোনো বিবেচনায় সম্পূর্ণ গণবিরোধী।

 


আরো সংবাদ



premium cement