২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
তিন দশকে বন্ধ হয়ে গেছে অর্ধেক তাঁত

ঐতিহ্যবাহী শিল্পটিকে বাঁচাতে হবে

-

বাংলাদেশের শত শত বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত তাঁতশিল্পের এখন চলছে মারাত্মক দুর্দিন। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন জেলার গৃহস্থালি ও কারখানার তাঁতগুলো। পুরুষানুক্রমে তাঁতনির্ভর জীবিকা নির্বাহ করায় যারা অভ্যস্ত, তাদের আনেকেই উপায় না দেখে ভিন্ন পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারের সূত্রে একটি জাতীয় দৈনিক জানিয়েছে, গত তিন দশকে দেশের অর্ধেক তাঁতই বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁতির মোট সংখ্যা নেমে এসেছে ১০ লাখ থেকে তিন লাখে। অপর দিকে, মাত্র ১৫ বছরের মধ্যেই দেশের ৯৫ শতাংশ হস্তচালিত তাঁতের কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। নরসিংদী-নারায়ণগঞ্জ এলাকা দীর্ঘকাল তাঁতের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এখন আর সেই গৌরব নেই। অথচ নরসিংদীর মাধবদী বস্ত্রশিল্পের জন্য ‘প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার’ হিসেবে ছিল সুপরিচিত। বর্তমানে হস্তচালিত তাঁতশিল্প প্রধানত তিন পার্বত্য জেলায় টিকে আছে। এ দেশের তাঁতের প্রায় ৫০ শতাংশ এখন রামাঙ্গাটি, খাগড়াছড়ি আর বান্দরবানে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তাঁতশুমারিতে এই শিল্পের করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশে একের পর এক হস্তচালিত তাঁত বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে এতে চিহ্নিত হয়েছেÑ ক. অন্য পেশায় আয় বেশি হওয়ায় অনেকের পেশা পরিবর্তন। খ. হস্তচালিত থেকে যন্ত্রচালিত তাঁতব্যবস্থায় স্থানান্তর। গ. তাঁতশিল্প অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজির সঙ্কট এবং ঘ. তাঁতপণ্য বাজারজাত করার সুব্যবস্থার অভাব। তাঁতশিল্পের ক্রমবর্ধমান দুর্গতির জন্য তাঁতের কাপড়ের ‘চাহিদা হ্রাস’ পাওয়াকেও দায়ী করেছেন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ। তারা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, মানুষের আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে তারা আরো মিহি বুননের বস্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। সিপিডির মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অভিমত, বিশেষত রাজধানী ঢাকার পাশের জেলাগুলোতে বড় শিল্পের উত্থানের কারণে ছোট হলেও ঐতিহ্যবাহীÑ এমন শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। এই থিঙ্কট্যাঙ্কের গবেষণা পরিচালক বলেছেন, ’৯০-এর দশক থেকে এসব জেলায় মুনাফামুখী বৃহৎ শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। এ সময় তাঁতসহ ছোট শিল্পগুলো দেশের প্রান্তিক এলাকায় সরে যায়। তিনি সরকারের নীতিগত সহায়তা অপর্যাপ্ত থাকাকেও তাঁতশিল্প বিকাশের অন্তরায় মনে করেন। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অভিমত, প্রযুক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণও দরকার। অন্তত সে কারণে বাঁচিয়ে রাখতে হবে তাঁতশিল্পকে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, ১৯৯০ সালে দেশে তাঁত ছিল সোয়া ১০ লাখেরও বেশি। পরবর্তী ১৩ বছরে তাঁতর সংখ্যা নেমে এসেছে ৯ লাখে। এর পরের ১৫ বছরে তাঁতের সংখ্যা দ্রুত কমে গেছে এবং এ সময় রেকর্ডসংখ্যক ছয় লাখ তাঁতি এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তাই গত বছর দেখা গেছে, মাত্র তিন লাখের কিছু বেশি তাঁতি আছেন হস্তচালিত তাঁতের পেশায়। বিগত তিন দশকে প্রায় এক লাখ তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। এখন গোটা দেশে তাঁতের সংখ্যা এক লাখ ১৬ হাজার। সমতলের বাঙালিদের পক্ষে তাঁতের ঐতিহ্য ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ার বিপরীতে, পার্বত্য জেলাগুলোর পাহাড়িরা তাঁতশিল্প বাঁচিয়ে রাখছেন। দেশের ৫৫ শতাংশ তাঁত এসব জেলায়। দেশের হস্তচালিত তাঁতগুলোর এক-তৃতীয়াংশও এ তিনটি জেলায়। শুমারি থেকে জানা যায়, দেশের ৯২ শতাংশ তাঁতই মাত্র ১৫ জেলায় অবস্থিত। এর মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ (চার হাজার); নরসিংদীর মতো ঐতিহ্যবাহী জেলা এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ স্থানে চলে গেছে।
তাঁতশিল্প ও তাঁতিদের সমস্যাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দূর করার কার্যকর উদ্যোগ অবিলম্বে নিতে হবে। হস্তচালিত তাঁতের জন্য সরকারের নীতিগত সহায়তা থাকতে হবে। নতুন নতুন নকশা ছাড়াও তাঁতপণ্যের বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অতীতে বাংলাদেশের তাঁতবস্ত্র আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। সেই সুদিন ফিরিয়ে আনা দরকার ।

 


আরো সংবাদ



premium cement