২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রিজার্ভ ৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, সহসা বাড়ার সম্ভাবনাও নেই

রিজার্ভ ৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, সহসা বাড়ার সম্ভাবনাও নেই - ছবি : বিবিসি

বাংলাদেশে ক্রমাগতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমার বিষয়টি ভবিষ্যতে ব্যাপক উদ্বেগের বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন যে বর্তমানে দেশের অর্থনীতির যে অবস্থা তাতে হঠাৎ করেই রিজার্ভ ঘুরে দাঁড়াবে না। ফলে, সামনের মাসগুলোতে রিজার্ভ নিয়ে সঙ্কটে পড়তে পারে সরকার।

অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগের কারণ রয়েছে। যেহেতু এটি এই মুহূর্তে একটি চলন্ত সূচক এবং এটি স্থির নয়। এটির ক্রমাবনতি হচ্ছে এবং এর বাড়ার সম্ভাবনা কম।

তার মতে, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার পরও আমদানি-রফতানির ভারসাম্য ঠিক রাখা যাচ্ছে না। আর রেমিটেন্সের প্রবাহও এখনো ঋণাত্মক। এর পাশাপাশি বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহ কম।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলছেন, আগামী পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে রিজার্ভ বাড়ার মতো কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ফলে সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম বড় দুটি মাধ্যম হলো রেমিটেন্স ও রফতানি আয়। এই দুই ক্ষেত্রে ডলারের প্রবাহ না বাড়লে ভবিষ্যতে সঙ্কটে পড়ার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা।

রিজার্ভ আসলে কত?
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারিতে দায় পরিশোধের পর রিজার্ভের পরিমাণ হয়েছে ৩১.১৯ বিলিয়ন ডলার। বলা হচ্ছে, গত ছয় বছরের তুলনায় এটি সবচেয়ে কম পরিমাণ রিজার্ভ। জানুয়ারিতেও এর পরিমাণ ছিল ৩২ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের যে হিসাব দিচ্ছে তাতে ফাঁক রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রিজার্ভের পরিমাণ আরো কম।

অর্থনীতিবিদদের মতে, রিজার্ভ বলতে বোঝায় তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহারযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের পরিমাণ কত সেটা। তাই যে অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহারের জন্য পাওয়া যায় না, তা রিজার্ভের মোট হিসাব থেকে বাদ দেয়ার কথা বলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।

এর মধ্যে রয়েছে রফতানি উন্নয়ন তহবিল ও উন্নয়ন অবকাঠামো খাতে সরকারি বিনিয়োগ।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রফতানি উন্নয়ন তহবিলে সাত বিলিয়ন বা সাত শ’ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা রয়েছে।

ওই হিসাবে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ সরকারি হিসাবেই দাঁড়ায় ২৪ বিলিয়নে।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর পরিমাণ ২০ থেকে ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে না।

অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আইএমএফয়ের সাথে রিজার্ভের একটা উপাদান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আর তা হচ্ছে ফরেন অ্যাসেট।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘ডিফারেন্ট অপিনিয়ন (ভিন্ন মতামত) থাকতে পারে, বাট দ্য ফরেন অ্যাসেট ইজ দেয়ার।’

অর্থনীতিবদরা বলছেন, এই পরিমাণ রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের বেশি আমদানি ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়। এটি সমস্যার কারণ হবে না যদি বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ ভালো থাকে।

আর তা না হলে কিংবা রিজার্ভের পরিমাণ না বাড়লে তা নিয়ে সরকার সঙ্কটে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আইএমএফয়ের শর্ত অনুযায়ী চলতি বছরের জুন মাসের শেষে নেট রিজার্ভের পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি দেখাতে হবে। আইএমএফয়ের কাছ থেকে নেয়া ঋণের কিস্তি চালু রাখতে হলে এই শর্ত পূরণ করতে হবে।

তিনি বলছেন, রিজার্ভে যে তিন-চার বিলিয়ন ঘাটতি রয়েছে তা পূরণ করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ বিক্রি অব্যাহত রাখার নীতিগত জায়গা থেকে সরতে হবে।

রিজার্ভ থেকে ২০২২ সালে ১২.৬১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করা হয়েছে।

রেমিটেন্সের প্রবাহ কেমন?
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে এখনো রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব ও বেশ কিছু উপায় রয়েছে।

বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘রেমিটেন্সের প্রবাহ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ গত দু’বছরে বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে শ্রমিক হিসেবে পাড়ি জমিয়েছে। এর মধ্যে ২০২২ সালে প্রায় ১১ লাখ নতুন শ্রমিক বিদেশ গিয়েছে। আর এর আগের বছর গেছে প্রায় ছয় লাখ। গত দু’বছরে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১০ ভাগ বেড়েছে।

তবে রেমিটেন্সের দিকে তাকালে দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর থেকে রেমিটেন্স আসায় একটা পতন হয়েছে।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যেখানে বাংলাদেশে প্রতিমাসে ২০০ কোটি ডলার করে রেমিটেন্স আসার কথা, সেখানে এটি কমে ১৫০-১৬০ কোটি ডলার করে আসছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রেমিটেন্সের প্রবাহ ২.০৩ শতাংশ কমে গিয়েছিল। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিটেন্স প্রবাহ কমেছে ১৫.১১ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতেও রেমিটেন্স কমেছে ২০ শতাংশ। এ মাসে রেমিটেন্স এসেছে ১৫৬ কোটি ডলার। এর আগের মাসে অর্থাৎ জানুয়ারিতে রেমিটেন্স এসেছিল ১৯৬ কোটি ডলার।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেছেন যে, গত বছরের তুলনায় এ বছর রেমিটেন্স বেড়েছে।

চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট রেমিটেন্স এসেছে ১৪.০১ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ১৩.৪৩ বিলিয়ন ডলার।

মেজবাউল হক বলেন, ‘একটা বিশেষ মাস ধরে রেমিটেন্সের প্রবণতা দেখানো ঠিক নয়। সেটা আবার ফেব্রুয়ারি মাস, যেটা তিন দিন কম।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে না বিষয়টি আসলে তা নয়। বরং তারা বৈধপথে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে না। আর এটা হচ্ছে ডলারের বিনিময় মূল্যে পার্থক্য থাকার কারণে।

দেশে বর্তমানে ডলারের বিনিময়ের সরকারি হার ১০৮ টাকা করে হলেও কার্ব মার্কেটে ডলার ১১৬ থেকে ১১৭ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।

ডলারের বিনিময় হারের এই পার্থক্য রোধ করা গেলে বৈধপথে আরো অন্তত ৫০ কোটি ডলার রেমিটেন্স আয় আনা সম্ভব বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

রফতানি আয় কি বাড়ছে?
বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে রফতানি আয় ৭.৮১ শতাংশ বাড়লেও তা এর আগের তিন মাসের তুলনায় কমেছে।

এর আগের তিন মাসে অর্থাৎ নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে রফতানি আয় ৫০০ কোটি ডলারের বেশি হলেও ফেব্রুয়ারিতে এটি কমে ৪৬৩ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রফতানির যে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে তা আসলে জাহাজীকরণের তথ্য। অর্থাৎ রফতানির জন্য এই মূল্যের পণ্য জাহাজে তোলা হয়েছে প্রতি মাসে।

কিন্তু এর বিপরীতে যে ডলার প্রবাহ হওয়ার কথা তা আসছে না বলে মনে করেন তিনি।

ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘আমাদের যা এক্সপোর্ট করা হয়েছে পরে সেখান থেকে অনেক কাট-ছাট হয়, শর্ট শিপমেন্ট হয়, ডিসকাউন্ট দিতে হয়, বায়াররা বিল পেমেন্ট করতে দেরি করেন ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো তো আগেও ছিল। নতুন কোনো বিষয় নয়।’

অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রফতানির ক্ষেত্রে যে তথ্যটা দেয়া হয় তা আসলে অর্ধসত্য। কারণ রফতানির আয়ের হিসাবে সামগ্রিক রফতানির সংখ্যাটা থাকে। কিন্তু এই রফতানির পেছনে যে আমদানীর ব্যয় আছে তা ধরা হয় না।

তার মতে, আমদানির ব্যয় বাড়ার কারণে রফতানির আয় বাড়ছে। কারণ আমদানিকৃত পণ্যের ভিত্তিতেই আমাদের রফতানির মূল পণ্য তৈরি পোশাক রফতানি হয়। আর তৈরি পোশাক শিল্পের বেশিরভাগ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়।

রফতানি ও রেমিটেন্সের আয় বাড়াতে হলে ডলারের বিনিময় হার বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি। তবে বিনিময় হার বাড়লে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ার আশঙ্কা থেকে সরকার ডলারের বিনিময় হার বাড়াতে আগ্রহী নয় বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী রফতানি করা হলে ওই রফতানির মুনাফা ১২০ দিনের মধ্যে অবশ্যই দেশে ফেরত আনতে হয়। তা না হলে ওই রফতানিকারক আর কোনো রফতানি করতে পারে না।

তাই বিনিময় হারের পার্থক্যের কারণে রফতানি আয় আসা বন্ধ নেই বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে যে ধরণের তথ্য আছে তাতে আমরা এ ধরণের কোনো সমস্যা দেখছি না।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement