২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বহুমুখী কর্মসংস্থান তৈরি করছেন মাওলানা সাজ্জাদ হোসাইন সজিব

বহুমুখী কর্মসংস্থান তৈরি করছেন মাওলানা সাজ্জাদ হোসাইন সজিব - নয়া দিগন্ত

"ফেসবুক, ইউটিউব সহ বড় বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিশ্বের বড় বড় কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা যারা আছেন, তাদের বেশির ভাগই বিধর্মী। আমাদের প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হলেন তারা, যারা দ্বীনি ইলম শেখেন এবং অন্যকে শেখান। আমরাও দ্বীনি ইলমের সাথে সম্পৃক্ত। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা অনুযায়ী আমরা শ্রেষ্ঠ মানুষদের একজন।' বিধর্মী হয়ে তারা যদি এতটা সফল হতে পারে, শ্রেষ্ঠ মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আমরা কেন ব্যবসায় সফল হতে পারবো না? আমরা কেন হাজার হাজার কর্মসংস্থান তৈরী করতে পারবো না?"

কথাগুলো বলছিলেন তরুণ আলেম উদ্যোক্তা মাওলানা সাজ্জাদ হোসাইন সজিব। গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে তার কোম্পানি শাই টি সম্পর্কে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়।

সাজ্জাদ হোসাইন সজিব ১৯৯৫ সালে মার্চের ৩০ তারিখ জগদল, পঞ্চগড়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবারে মা-বাবা, দুই ভাই, এক বোন এবং স্ত্রী ও এক মেয়ে রয়েছে। মাওলানা সাজ্জাদ হোসাইন পরিবারের বড় ছেলে। ছোট দুই ভাই রাজধানীর লালমাটিয়া মাদরাসায় অধ্যয়নরত আছেন এবং তার সর্বকনিষ্ঠ বোন পঞ্চগড় শহরের এক মহিলা মাদরাসায় পবিত্র কোরআনের হিফজ করছে।

মাওলানা সাজ্জাদ বগুড়া জেলার গোদারপাড়া বাজার সংলগ্ন মাদরাসাতুল উলূমিশ শারইয়্যাহ'য় দীর্ঘ ১০ বছর পড়াশোনা করেন। নূরানী, হিফজ এবং শরহে বেকায়া জামাত পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানেই পড়াশোনা করেন। এরপর জালালাইন ও মেশকাত পড়েছেন ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দ মাদরাসায়।

দাওরায়ে হাদীস পড়েছেন ঢাকার 'জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ' মাদরাসায়। সবশেষে তিনি ইফতা পড়েছেন মিরপুরের 'মারকাযুদ দিরাসাতিল ইসলামিয়্যাহ মাদরাসায়।

মাওলানা সাজ্জাদ হোসাইন সজিব বলেন, সাধারণ মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গিয়েছিল আলেমরা পরনির্ভরশীল। মসজিদ, মাদরাসা আর খানকা ছাড়া তারা আর কোথাও কাজ করতে জানেন না। অথচ কথাটি পুরোপুরি অবাস্তব। আপনি খোঁজ নিলে দেখতে পাবেন হাজার হাজার আলেম মসজিদ-মাদরাসায় খেদমতের পাশাপাশি ব্যবসাও করছেন। শুধু তা-ই নয়, তারা ব্যবসায়ী হিসেবে সফলতার স্বাক্ষর-ও রাখছেন৷

তিনি বলেন, 'কওমি উদ্যোক্তা' নামে ফেসবুকে দুই লাখের বেশি সদস্যের জনপ্রিয় একটি ফেসবুক গ্রুপ আছে। এই গ্রুপের অনুপ্রেরণায়-ই তার শাই টি'র সূচনা৷ প্রত্যেক মাসে এই জনপ্রিয় গ্রুপের মাধ্যমে কোটি টাকার কেনাবেচা হয়।

তিনি বলেন, পড়াশোনা শেষ করে আমি এক বছরের জন্য তাবলীগে (সাল চিল্লায়) বের হয়েছিলাম। সময় শেষ হওয়ার কিছুদিন আগে হঠাৎ বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ শুরু হয়৷

সফর থেকে ফিরে এসে বাবার প্রতিষ্ঠিত রড, সিমেন্ট, পাথর, বালি, ইট, কনস্ট্রাকশন ও স্যানিটারির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সময় দেই৷ করোনার বিধিনিষেধের ওই সময়টুকুতে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করতে থাকি। একদিন চোখ পড়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বিভিন্ন পণ্য নিয়ে ব্যবসা করছে।

আমি শখের বসে পঞ্চগড়ে উৎপাদিত শুকনো মরিচ ও বাদামের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করি। এতে ভালো সাড়া পাই।

আমার মাথায় একটি আইডিয়া আসে– সারাদেশে আমাদের পঞ্চগড় জেলার সমতল ভূমির চায়ের চাহিদা বেশ ব্যাপক। আমি এই চা পাতাকে অনলাইনে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে সাড়া ফেলতে পারি এবং এটি নিয়ে খুব সহজেই আমি ব্যবসা করতে পারি।

অতঃপর এলাকায় যারা আগ থেকেই চায়ের ব্যবসা করেন, এমন কয়েকজনের কাছ থেকে চা-পাতা কিনে ফেসবুকের মাধ্যমে বিক্রি শুরু করি। এই পণ্যেও আশাতীত সাড়া পেলাম।

পরে ভেবে দেখলাম, আমি নিজস্ব মোড়কে, নিজস্ব লাইসেন্সে একটি ব্র্যান্ড দাঁড় করাতে সক্ষম হলে আমার এই ব্র্যান্ডের মাধ্যমে একসময় অসংখ্য কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব হবে৷ আমি অধমের এই অগ্রণী ভূমিকা হয়তো অনেকের রিজিকের মাধ্যম হিসেবে আল্লাহ তায়ালার কাছে কবুল হবে এবং একদিন আমি উঁচু স্বরে বলতে সক্ষম হবো যে ওলামায়ে কেরাম কখনো পরনির্ভরশীল নয়!

মাওলানা সাজ্জাদ বলেন, ব্যবসা বড় করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল পুঁজির। আমি চাইলে বাবার কাছ থেকে বড় বিনিয়োগ চাইতে পারতাম। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল নিজে থেকেই শুরু করার। এক্ষেত্রে আমার শ্রদ্ধেয় "মা" আমাকে ব্যাপক সহযোগিতা করলেন। তিনি আমার এগিয়ে যাওয়ার সাহসিকতা অনুভব করে তার স্বর্ণালঙ্কার হতে কিছু অলঙ্কার বিক্রি করে আমার হাতে নগদ ৫০ হাজার টাকা তুলে দিলেন। আমার বাবা এবং আমার সহধর্মিণীর ভূমিকাও ছিলো ব্যাপক৷ এতটুকু পুঁজি ও সবার দোয়া নিয়ে শুরু হয় আমার পথচলা৷

ব্যবসায় যখন আমি ভালো করছিলাম, তখন অনেকেই আমার ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে চাইলেন। আমি তাদের মধ্যে বেছে বেছে সৎ ও বিশ্বস্ত কিছু মানুষের বিনিয়োগ গ্রহণ করলাম। আলহামদুলিল্লাহ, দিন যত যাচ্ছে আল্লাহ আমার ব্যবসায় বরকত দিচ্ছেন।

মাওলানা সাজ্জাদ হোসাইন সজিব বলেন, শাই টি কোম্পানির প্রোডাকশন ডিপার্টমেন্টে এই মুহূর্তে ১২ জন কর্মী আছেন। অন্যান্য ডিপার্টমেন্টে কর্মকর্তা রয়েছেন আটজন। বিভাগীয় প্রতিনিধি আছেন কয়েকজন। এ ছাড়াও সারাদেশে ৬০ জনের বেশি নিবন্ধিত ডিলার বা পরিবেশক ও ডিপো আছেন। কোম্পানির এসেট, মেশিনারিজ ও আনুষাঙ্গিক সব মিলিয়ে আমাদের কোম্পানিতে বর্তমানে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় দুই কোটি টাকা।

প্রতিদিন আমাদের গড়ে এক টন (১ হাজার কেজি) চা পাতা দেশের বিভিন্ন ডিলারের নিকট ডেলিভারি হয়। যার গড় মূল্য প্রায় আড়াই লাখ অনূর্ধ্ব।

এ অনুযায়ী প্রতি মাসে ২৬ কার্যদিবসে কোম্পানিতে প্রায় ৫/৬ কোটি টাকার (কম-বেশি) বেচাকেনা হয় বলে জানান মাওলানা সাজ্জাদ।

শাই টি'র ব্যবসায়িক কার্যক্রম আরো গতিশীল করতে আগামী ১ অক্টোবর দেশের সব ডিলারদের নিয়ে 'ডিলার সম্মেলন ২০২২' আয়োজন করতে যাচ্ছে তারা৷

শাই টি ছাড়াও ভিন্ন আরো দুইটি প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেছেন মাওলানা সাজ্জাদ হোসাইন সজিব।

১৷ আল-হিকমাহ টি এসোসিয়েট
এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে কাঁচা চা পাতা ক্রয়-বিক্রয়, গ্রিন টি ম্যানুফ্যাকচারিং, স্মল টি গার্ডেন ও লুজ বস্তা চায়ের পাইকারি ব্যবসা করছেন। ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে চা ফ্যাক্টরি করার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন তিনি।

২৷ আল-হিকমাহ ট্যুর এন্ড ট্রাভেলস
হজ, উমরাহ, যিয়ারাহ ও ই-টিকেটিং এবং ভ্রমণ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান এটি।

মাওলানা সাজ্জাদ বলেন, বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ বড় বড় কোম্পানি ব্যবসায় নেমেই কিন্তু এত বড় বা প্রসিদ্ধ হয়নি। তারা এক-দেড় শ' বছর কাজ করে এই পর্যায়ে এসেছে। আমাদের কোম্পানির মাত্র দুই বছর হলো। আমরাও অনেক বড় পরিসরে কাজ করার স্বপ্ন দেখি।

আলেমদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা আছে। আমরা সেই আস্থার জায়গাটা ধরে রেখেই ব্যবসা করতে চাই।
দেশবরেণ্য ওলামায়ে কেরামগণ আমাদেরকে উৎসাহিত করছেন। আমাদের চা পান করে প্রশংসাও করছেন।

মাওলানা সাজ্জাদ হোসাইন সজিব বলেন, আমাদের প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবসা করেছেন। তিনি ব্যবসায়ী হিসাবে সবার কাছে বিশ্বস্ত ছিলেন। আমি নবীজির অনুসরণেই সততার সাথে ব্যবসা করতে চাই। একজন আলেম যখন ব্যবসায়ী হন। তিনি আরো বহু মানুষের কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করেন। আলেম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের উপকার বেশি হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

দেশের সকল জনগণের দোয়া, ভালোবাসা এবং সমর্থন সঙ্গে নিয়ে 'শাই টি'-কে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তরুণ এই আলেম উদ্যোক্তা।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল