২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

১৪টি ফসলের উৎপাদন খরচ চূড়ান্ত, কী লাভ কৃষকের?

-

কৃষি বিপণন অধিদফতর জানিয়েছে যে, বাংলাদেশের কৃষকরা উৎপাদন করেন এমন ১৪টি কৃষিপণ্যের গড় উৎপাদন খরচ চূড়ান্ত করা হয়েছে।

এই কৃষিপণ্যগুলো হলো পেঁয়াজ, রসুন, সরিষা, মসুর ডাল, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, টমেটো, কাচা পেঁপে, ঢেঁড়স, শীম, বেগুন, কাঁচামরিচ এবং লাউ।

এই প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাদিত পণ্য যৌক্তিক মূল্যে বিক্রি করে লাভবান হতে পারেন এবং একই সাথে পাইকারি, ফড়িয়া ও খুচরা ব্যবসায়ীরাও যেন যৌক্তিক মূল্যে পণ্য বিপণন করেন, সেদিকে লক্ষ্য করেই এটা করা হয়েছে।

কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, দেশের প্রচলিত কৃষিপণ্য বিপণন আইন অনুযায়ী পণ্যের উৎপাদন খরচ নির্ধারণের সুযোগ আছে।

‘কৃষক, সরকার ও ভোক্তাদের পণ্য সম্পর্কে আগাম ধারণা দেয়ার পাশাপাশি, যে কোনো সঙ্কট তৈরি হলে সরকার যাতে ব্যবস্থা নিতে পারে, সেজন্যই সবকিছু বিশ্লেষণ করে এসব পণ্যের উৎপাদন খরচ চূড়ান্ত করা হয়েছে,’ বলেন তিনি।

মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, বহুল প্রচলিত কৃষিপণ্য ধান ও আলুর বাইরে এসব পণ্যের উৎপাদর খরচ নির্ধারণ করার বিষয়ে এবারই প্রথম এমন উদ্যোগ নেয়া হলো।

কৃষি বিপণন অধিদফতর চালের উৎপাদন খরচ আগে থেকেই নির্ধারণ করে আসছে, আর গত বছর থেকে চালু হয়েছে আলুর উৎপাদন খরচ। এবার সে তালিকায় যোগ হলো নতুন এই ১৪টি কৃষিপণ্য।

‘সামনে আরো কিছু পণ্য এই তালিকায় আসবে। মূলত আমরা বছরে দু'টি মৌসুমের উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করে দিবো,’ বলেন কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক।

কিসের ভিত্তিতে উৎপাদন খরচ

অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, জমিতে থাকা অবস্থা একটি ফসলের প্রতি কেজি উৎপাদনে কত খরচ হচ্ছে, তার গড় করে একটি হিসাব তৈরি করা হচ্ছে।

‘এতে জমির ভ্যালু, কৃষি উপকরণ - যেমন সার, বীজ, কীটনাশক, চাষের খরচ, শ্রম খরচ, ঋণ থাকলে তার সুদ - এমন সংশ্লিষ্ট সব কিছু ধরে উৎপাদন খরচ ঠিক করা হয়েছে।’

ওই খরচের নিচে দাম পেলে কৃষকের লোকসান হবে আর বেশি হলে লাভ হবে। ফলে এর উপর ভিত্তি করে সরকার পণ্যগুলোর একটি ন্যূনতম দাম ঠিক করতে পারে, যা কৃষককে সুরক্ষা দেবে বলে জানান মোহাম্মদ ইউসুফ।

চলতি বছরে পেঁয়াজের প্রতি কেজিতে উৎপাদন খরচ ১৯.২৪ টাকা, রসুনের ৩০.৮৭ টাকা, মরিচের ১৯ টাকা, সরিষা ৩৩.৮৪ টাকা এবং মসুর ডালের উৎপাদর খরচ ৪০.৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাকিগুলোর উৎপাদন খরচ আগামী কয়েকদিনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে বলে জানাচ্ছেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা।

বাংলাদেশে সবজি উৎপাদন অনেকটাই প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল, তাই মাঝেমধ্যেই উৎপাদনে নানা সঙ্কট তৈরি হয়।

আবার এক বছর কোনো সবজির ভালো দাম পেলে পরের বছর কৃষকরা সেই ফসল বেশি আবাদ করেন, ফলে পরের বছর আবার তার দাম পড়ে যায়। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বিপণনে এটি অন্যতম একটি সমস্যা, যা নিরসনে উৎপাদন খরচ নির্ধারণের বিষয়টি ভূমিকা রাখতে পারে।

মোহাম্মদ ইউসুফ মনে করেন, পেঁয়াজের যে উৎপাদন খরচ চলতি বছর নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে বাজারে খুচরা পর্যায়ে কেজি প্রতি সর্বোচ্চ ৩৫ টাকা হতে পারে এর দাম।

‘এখন ধরুন পেঁয়াজ নিয়ে সঙ্কট তৈরি হলো। সরকারও একটা পলিসি নির্ধারণ করতে পারবে (এর দাম নির্ধারণে)। আবার বীজ বা সারের দাম বাড়লে ভর্তুকিসহ নানা সুবিধা কৃষকরা চাইতে পারবে,’ বলেন তিনি।

ইউসুফ আরো বলেন, সব মিলিয়ে সুবিধা হবে ভোক্তার, কারণ উৎপাদন খরচ থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের দাম সম্পর্কেই তার ধারণা থাকবে।

আলুর অভিজ্ঞতা কেমন

কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক জানান, গত বছর তারা আলুর উৎপাদন খরচ ঠিক করেছিলেন কেজি প্রতি ৮.৩২ টাকা এবং পরে বাজারে বিক্রির জন্য গড় দাম ২১/২২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিলো।

‘এরপর হিমাগার সঙ্কট, বন্যা-সহ নানা কারণে ব্যবসায়ীরা আবেদন করে দু'টাকা বাড়িয়েছিলো। কিন্তু উৎপাদন খরচ জানা থাকায় এ নিয়ে বড় সঙ্কট কেউ তৈরি করতে পারেনি।’

তিনি বলেন, আবার সরকার যদি দেখতো যে সঙ্কট হচ্ছে, তাহলে আগেই আমদানির উদ্যোগ নিতে পারতো।

বাজারে ভোক্তার কী সুবিধা হবে

কৃষিপণ্যের বাজার বিপণন বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, উৎপাদন খরচ নির্ধারণ একটা ভালো উদ্যোগ, কিন্তু সরকার যদি নিজে পণ্য না কেনে তাহলে এই চেষ্টা বাজারে খুব বেশি ভূমিকা রাখবে না।

‘এখানে কৃষিপণ্যের বাজারের অনেক বৈশিষ্ট্য আছে। সিন্ডিকেট, রাজনীতি, চাঁদাবাজি-সহ হরেক রকম সমস্যা আছে। এই যে দেখুন, এখন বগুড়ায় ফুলকপি ২/৩ টাকা এবং কয়েকদিন পর মাঠেই পরে থাকবে। মূলার ক্ষেত্রেও তাই। তাহলে উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করে লাভ কোথায় হবে?’

ড. হাসান বলেন, সরকার যদি কৃষকের কাছ থেকে যথাযথ মুনাফা দিয়ে পেঁয়াজ, রসুন, আদা-সহ বিভিন্ন ধরণের সবজি কেনে, তাহলে উৎপাদন খরচের ভিত্তিতে একটা দাম ধরে বাজারে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হতে পারে।

তবে কৃষি বিপণন অধিদফতরের সহকারী পরিচালক নাসরীন সুলতানা জানান, ফসল উত্তোলন মৌসুমে বাংলাদেশের বেশিরভাগ কৃষকেরই পণ্য গুদামজাতকরণ বা সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা নেই ।

‘এ কারণে ভোক্তাকে সুবিধা দিতে হলে আগে কৃষক পর্যায়ে সবজির সংগ্রহ ও স্বল্পকালীন সংরক্ষণ সুবিধার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।’

এছাড়া, কৃষকদের সংগঠিত করে সবজি চাষীদের সমবায় সমিতি গঠন করা যেতে পারে, যাতে করে তারা পণ্যের ন্যায্য বিক্রয়মূল্য পেতে দরকষাকষির অবস্থানে যেতে পারে - এমন পরামর্শ দিচ্ছেন এই কর্মকর্তা।

তার মতে, সংগঠিত সবজি বাজারের অভাবের কারণে অনেক সময় ভোক্তা পর্যায়ে সঠিক মূল্য নির্ধারণ সম্ভব হয় না।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement