১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চীন মালয়েশিয়ার চেয়ে খরচ বেশি বাংলাদেশে

চীন মালয়েশিয়ার চেয়ে খরচ বেশি বাংলাদেশে - ছবি : সংগৃহীত

প্রতি কিলোমিটারে শত কোটি টাকা খরচে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি থেকে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত দুই লেনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হবে। ভূমি অধিগ্রহণ খরচ বাড়ায় কিলোমিটারে খরচ দাঁড়াচ্ছে শত কোটি টাকা। দীর্ঘ সময় ধরে প্রকল্পটির অনুমোদন ঝুলে থাকলেও এখন একনেকে যাচ্ছে অনুমোদনের জন্য। কলকাতা, চীন ও মালয়েশিয়ার চেয়ে প্রতি কিলোমিটারে খরচ বাংলাদেশে অনেক বেশি। এই তিন দেশে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ৪৯ কোটি থেকে ৫৮ কোটি টাকার মধ্যে বলে সেসব দেশের প্রকল্পগুলো থেকে জানা গেছে। অনুমোদনের জন্য আগামী মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটির প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সক্ষমতার অভাব রয়েছে। বাস্তবায়নে সময় বেশি লাগছে। এ ছাড়া দীর্ঘসূত্রতা, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা ও দুর্নীতির কারণেই বাংলাদেশে নির্মাণ প্রকল্পে খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি।

সেতু বিভাগের পাঠানো প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি থেকে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত বিদ্যমান সড়ক দুই লেনে প্রশস্তকরণ এবং দুই লেন বিশিষ্ট এলিভেটেড একপ্রেসওয়ে নির্মাণের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের সাথে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর ও ব্যয়সাশ্রয়ী করা হবে। পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুর সড়কের প্রশস্ততা গড়ে ৬ মিটার। দৈনিক যানবাহন চলাচল করছে গড়ে ১৭ হাজার ৯১০টি। ট্রাফিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, এই যানবাহনের সংখ্যা হতে পারে আগামী ২০২৩ সালে দৈনিক গড়ে ২৩ হাজার ৯২০টি, ২০২৮ সালে ৩০ হাজার ৫৬০টি, ২০৩৩ সালে ৩৯ হাজারটি এবং ২০৪৩ সালে ৬৩ হাজার ৫৮০টি। উড়াল সড়কটি হলে যানবাহনের গতিসীমা প্রায় পাঁচগুণ বাড়বে। যানবাহনের বিলম্ব সময় ৭৪.৭৪ শতাংশ কমে আসবে। সেতু কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে স্বতন্ত্র পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দিয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সম্ভাব্যতা যাচাই করে। সড়ক প্রশস্তকরণসহ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ২২৭ কোটি ৭৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। যার মধ্যে ১ হাজার ৫ কোটি ৭৬ লাখ ৮৮ হাজার টাকা সরকারি অনুদান, বাকি ২২২ কোটি ৫৭ হাজার টাকা সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন।

প্রকল্পের আওতায় কাজগুলো হলো- ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন সাড়ে ৪৪ একর, ৭ লাখ ১ হাজার ১৪০.২০ ঘন মিটার মাটির কাজ, পৌনে ১১ কিলোমিটার পেভমেন্ট ও আনুষঙ্গিক কাজ, ১৪.৭৯ কিলোমিটার মধ্যবর্তী প্রতিবন্ধক নির্মাণ, ৯.০৬ কিলোমিটার র্যাম্পসহ উড়াল সড়ক (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে), ২৫ মিটার সেতু নির্মাণ, ২৫.৩১ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ, ২০ হাজার ১৯৩.৭৫ বর্গমিটার রোড মার্কিং এবং ২৪৮ ঘন মিটার বক্স কালভার্ট নির্মাণ। এ ছাড়া ৬টি র্যাম্প, চারটি টোল প্লাজা, যানবাহনের ওজনের জন্য ৬টি ওজন স্টেশন নির্মাণ করা হবে।

এ দিকে প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, র্যাম্পসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়াল সড়ক হবে ৯ দশমিক ৬ কিলোমিটার। যার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯০৬ কোটি ৭৩ লাখ ২১ হাজার টাকা। এখানে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে বাস্তবায়নকারী সংস্থার দর অনুযায়ী ১০০ কোটি ৮ লাখ টাকা। বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পার্শ্ববর্তী দেশের কলকাতায় গত বছর চালু করা হয় মহানগরীর দীর্ঘতম পরমা ফ্লাইওভার। ৮ দশমিক ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই ফ্লাইওভার নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩৯২ কোটি টাকা। প্রতি কিলোমিটারে নির্মাণ খরচ ৪৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের শত কিলোমিটারের দীর্ঘ পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি খরচ হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। আর মালয়েশিয়ায় ১০ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় হয়েছে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

প্রকল্পে ৪৪ দশমিক ৪৯৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে খরচ ধরা হয়েছে ৮৩৬ কোটি ৩৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। ফলে একর প্রতি ভূমির দর হচ্ছে ১৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। সড়কের জন্য ১০ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার পেভমেন্ট ও আনুষঙ্গিক কাজ করতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮৮ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এখানে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ১৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। ২৫.৩১ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ করতেই ব্যয় হবে ৩৩ কোটি ৪৪ লাখ ১২ হাজার টাকা। প্রতি কিলোমিটার ড্রেনে ব্যয় হবে ১ কোটি ৩৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। মাত্র ১৫১ মিটার সেতু প্রশস্তকরণে খরচ ২২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। অস্থায়ী সড়ক নির্মাণে ৯.৩৫ কিলোমিটারে খরচ ১২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এখানে কিলোমিটারে ব্যয় ১ কোটি ৩৮ লাখ ৯৩ হাজার টাকা।

সেতু বিভাগ বলছে, ওই মহাসড়কে প্রতিদিন যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে প্রতিদিন ১৭ হাজার ৯১০টি যানবাহন চলাচল করে। এই যানবাহনের চাপ আগামী ২০৩৩ সালে ৩৯ হাজারে উন্নীত হবে। চাপ কমাতে এবং সময় বাঁচাতেই এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের প্রস্তাব। এতে ভ্রমণ সময় ৬২.৮৯ শতাংশ কমবে। সাড়ে চার বছরে প্রকল্প সমাপ্ত করা হবে। আগামী জানুয়ারিতে শুরু হলে ২০২৫ সালের জুনে শেষ করার প্রত্যাশা রয়েছে।

প্রকল্পটির ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মামুন আল রশীদের সাথে গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সাথে কথা বলা যায়নি। সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা, ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা ও দুর্নীতির কারণেই বাংলাদেশে প্রকল্প খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। তিনি বলেন, যখন ডিপিপি তৈরি করা হয় তখনই নির্মাণ উপাদানের দর বেশি ধরা হয়। তাদের ভাষ্য- মূল্যস্ফীতির কারণে বারবার ডিপিপি সংশোধন করা সময়সাক্ষেপ। তিনি জানান, এ ছাড়া আমাদের দেশে এক্ষেত্রে বাড়তি দর ধরার সংস্কৃতি আছে। পাশাপাশি সুশাসনেরও অভাব রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখতের মতে, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সক্ষমতার অভাবের কারণেই আমাদের দেশে নির্মাণ খাতে খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। যেকোনো প্রকল্পে দেখা যায় টাইম ওভাররান হয়ে যায়। সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা তো আছেই। এ ছাড়া আমাদের এখানে যখন কস্ট বেনিফিট পর্যালোচনা করা হয়, তখন কস্ট বেনিফিটটা এত বেশি থাকে, কস্টটা পুষিয়ে যায়। আমরা বাস্তবায়ন সক্ষমতা বাড়াতে পারলে নেট বেনিফিটটা বেশি হবে। তিনি বলেন, এমনও তথ্য সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে যে, প্রকল্পে পরিচালক পেতেই চার মাস সময় পার হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে দেখা গেল একদিনেই লোক পাওয়া গেছে। টাইম ওভাররান হয় বলেই আমাদের এখানে খরচ বেশি। তিনি বলেন, বাস্তবায়ন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় বাড়াতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement