২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অতিক্রম করল সরকারের ব্যাংক ঋণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও

-

বিদায়ী অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ গ্রহণ করল ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা কি না সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি। সংশোধিত বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮২ হাজার কোটি টাকা, যা মূল বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ। মূল বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। সরকারি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩০ জুনভিত্তিক পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিদায়ী অর্থবছরের সরকার ব্যাংকঋণের মধ্যে প্রায় ৭৯ হাজার কোটি টাকাই নেয়া হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে। বাকি ৬ হাজার কোটি টাকা নেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে। ব্যাংকঋণের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণই বেশি। অর্থাৎ ১০ বছর, ১৫ বছর ও ২০ বছর মেয়াদি বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেয়া হয়েছে বেশি পরিমাণ।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের জন্য ৮৪ হাজার কোটি টাকার ব্যাংকঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে ছিল প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সরকারের কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় ব্যয় ঠিক রাখতে শেষ মুহূর্তে ব্যাংক খাত থেকেই অতিরিক্ত ঋণ নিতে হয়। বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ব্যাংকঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৪৭ হাজার কোটি টাকা থেকে ৮২ হাজার কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু এতেও কুলাতে না পেরে শেষ মুহূর্তে তা বেড়ে ৮৫ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে।

ব্যাংকারদের মতে, এতে দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো ফল বয়ে আনছে না। কারণ, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করলে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন হয়। সৃষ্টি হয় বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। বাড়ে অর্থনৈতিক লেনদেন। আর অর্থনৈতিক লেনদেনের বেশির ভাগই হয় ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে। এতে ব্যাংকেরও ব্যবসা বাড়ে, বাড়ে শাখা প্রশাখা। সামগ্রিকভাবেই অর্থনৈতিক চাকা সচল হয়। কিন্তু যেভাবে ব্যাংক খাত থেকে বাড়তি ঋণ ছেঁকে নেয়া হচ্ছে তাতে বেসরকারি খাতের ঋণ দেয়ার মতো অর্থ ব্যাংকের কাছে থাকবে না। আর চলমান পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ ব্যাংকই বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এর অন্যতম কারণ হলো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার একটি অলিখিত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ব্যাংক থেকে রাঘববোয়ালরা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছেন না। তাদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অবস্থান গ্রহণ না করে বরং বিভিন্ন নীতিসহায়তা দিয়ে ছাড় দেয়া হচ্ছে। এতে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়েছে। এই ৯ শতাংশ সুদে উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ দিয়ে ফেরত পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর সরকারের দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দিলে ১০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পাওয়া যায়। একই সাথে ব্যাংকগুলোর যেকোনো সঙ্কট মেটাতে সরকারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধার নেয়া যাবে। এ কারণে এখন বেশির ভাগ ব্যাংক বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করার পরিবর্তে সরকারের ঋণ দিতেই বেশি উৎসাহী হয়ে পড়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী সোমবার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বর্তমানে এমনিতেই ব্যাংকের আমানত তলানিতে নেমে গেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত ছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে আমানত বলা চলে পাওয়াই যাচ্ছে না। এক দিকে ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর করায় ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। যেখানে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি অবস্থান করছে, সেখানে ৬ শতাংশে সুদে আমানত রেখে প্রকৃতপক্ষে আমানতকারীরা বছর শেষে কোনো মুনাফাই পাচ্ছেন না। উপরন্তু মুনাফার ওপর সরকারের ট্যাক্স কাটার পর আমানতকারীরা ১০০ টাকা আমানত রেখে মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় বছর শেষে তাদের মূলধন কমে যাচ্ছে। এ কারণে আমানতকারীরা ব্যাংকে আমানত রাখতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন।

অপর দিকে, করোনার কারণে মানুষের আয় কমে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বেতনভাতা পরিশোধ করতে পারছে না। লোকসানের ধকল সহ্য করতে না পেরে শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে। চালু প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মাস শেষে বড় অঙ্কের আমানত পাওয়া যেত। কিন্তু করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এখান থেকে তেমন আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। সবমিলেই কমে গেছে আমানত।

একই সাথে কমে গেছে ঋণ আদায়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ আদায়ের ওপর শিথিল করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কেউ ঋণ পরিশোধ না করলে তাকে খেলাপি বলা যাবে না। প্রথমে এ সুযোগ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এবং পরে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এর ফলে ব্যাংকের নগদ আদায় অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। অপর দিকে ব্যাংকিং খাতে খেলাপিঋণ বেড়ে যাওয়ায় তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বেড়ে গেছে।

এমনি পরিস্থিতিতে অনেকটা উভয় সঙ্কটে পড়ে গেছেন ব্যাংকাররা। এ কারণে দিন শেষে বিনিয়োগ নিয়ে একটু নিশ্চিন্তে থাকতে সরকারের বিল বন্ডেই বিনিয়োগ দিতে তারা উৎসাহিত হয়ে পড়েছেন। কারণ, বেসরকারি খাতে বড় উদ্যোক্তারা যে ঋণ নিচ্ছেন তার বেশির ভাগই আদায় করা যাচ্ছে না। যেটুকু আমানত পাচ্ছেন তা ঝুঁকিবিহীন খাত সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ দেয়া হচ্ছে। আর সরকারেরও প্রয়োজন বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ঋণগ্রহণ।

ব্যাংকারদের মতে, এভাবে সরকারের ঋণ দিয়ে ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়ালে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরো স্থবির হয়ে পড়বে। বছর শেষে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন মোটেও সম্ভব হবে না।


আরো সংবাদ



premium cement