২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মন্দ ঋণ বড় চ্যালেঞ্জ ব্যাংক খাতের

মোট খেলাপির ৯০ শতাংশ আদায় অযোগ্য
- ফাইল ছবি

ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৯০ ভাগই এখন আদায় অযোগ্য অর্থাৎ মন্দ ঋণে পরিণত হয়ে পড়েছে। এ মন্দমানের খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন ব্যাংকাররা। তাদের মতে, মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্থবিরতা নেমে আসছে। কমে যাচ্ছে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা। মন্দ ঋণের আধিক্য কমাতে না পারলে দিন শেষে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এমন অবস্থা বিরাজ করছে। তারা আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এ কারণে একটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে অবসায়ন করা হয়েছে। মন্দমানের খেলাপি ঋণ আদায়ে তাই শক্ত পদক্ষেপ নিতে না পারলে ব্যাংক খাত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে তারা মনে করছেন।

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আব্দুল হালিম চৌধুরী গত সপ্তাহে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, সবাই করোনার কারণে ব্যাংকের আয় কমে যাওয়া নিয়ে আলোচনা করছেন। কিন্তু করোনার প্রভাবের চেয়েও ব্যাংকিং খাতে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে মন্দ ঋণ। ব্যাংকগুলোতে এ মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর পরিচালনব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে ব্যাংকের অর্জিত মুনাফা বা সুদ আয় খাতে নেয়া যাচ্ছে না। বিপরীতে মন্দ ঋণের কারণে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। অপর দিকে, যেসব ঋণ মন্দ হয়ে যাচ্ছে ওই সব ঋণতো আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের দিন শেষে ব্যাংকের মুনাফাসহ ফেরত দিতে হচ্ছে। কিন্তু মন্দ ঋণের বিপরীতে কোনো আয় পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি মনে করেন, এ কারণে এই মুহূর্তে মন্দ ঋণই ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত ডিসেম্বরের আগে বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে দীর্ঘ ১০ বছরের জন্য নবায়ন করা হয়। এ সুবাদে খেলাপি ঋণ প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা থেকে ৯২ হাজার কোটি টাকায় নামে। গত মার্চ প্রান্তিকে তা সামান্য বেড়ে হয় ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। এর অন্যতম কারণ হলো, গত জানুয়ারি থেকে কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ না করলে তাকে ঋণখেলাপি করা যাবে না বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ সুযোগ প্রথমে ছয় মাসের জন্য অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে এ সুযোগ আরো তিন মাস বাড়িয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। এ কারণে মার্চ প্রান্তিকের মতো, জুন ও আগামী সেপ্টেম্বর প্রান্তিকেও খেলাপি ঋণের হিসাবে তেমন হেরফের হবে না। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে যেটুকুও খেলাপি ঋণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে এর মধ্যে মন্দ ঋণই প্রায় ৯০ শতাংশ। গত মার্চ শেষে ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দ ঋণ প্রায় ৮১ হাজার কোটি টাকা। আর ব্যাংকভেদে ধরলে সরকারি ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৯২ শতাংশ।

ব্যাংক খাতের হিসাবের বাইরেও আরো খেলাপি ঋণ রয়েছে আলাদা হিসাবে। প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আছে যা অবলোপন করা আছে। কোনো খেলাপি ঋণ তিন বছরের বেশি আদায় না হলে ওই ঋণ অবলোপন করা হয়। অর্থাৎ ব্যাংকের আলাদা হিসাবে রাখা হয়। ওই ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংক মামলা মোকদ্দমা করে থাকে। এর বাইরে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আছে তা উচ্চ আদালতে রিট করা আছে। কোনো ঋণখেলাপি উচ্চ আদালত থেকে খেলাপি ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নেয়া হলে ওই ঋণ আর খেলাপি ঋণ হিসাবে দেখানো যায় না। এভাবে নানাভাবে খেলাপি ঋণের বাইরে মন্দ ঋণ ব্যাংকের হিসাবে আছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, মন্দ ঋণই হলো ব্যাংকিং খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ। কারণ, ব্যাংকগুলো একটি নির্ধারিত হারে আমানতকারীদের কাছ থেকে অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করে। ওই অর্থ আবার উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ৬ শতাংশ মুনাফায় ১০০ টাকা আমানত নিয়ে বছর শেষে মুনাফাসহ আমানতকারীকে ১০৬ টাকা ফেরত দিতে হয়। আর ১০০ টাকার আমানত সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করা যায় ৮৭ শতাংশ। বাকি ১৩ টাকা এসএলআর ও সিআরআর হিসেবে রাখতে হয়। ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়ায় ৮৭ টাকা বিনিয়োগ করে ব্যাংক বছর শেষে মুনাফা পায় ৭ টাকা ৮৩ পয়সা। অর্থাৎ ঋণ ঠিক মতো আদায় হলে বছর শেষে এসএলআর ও সিআরআর ১৩ শতাংশসহ ব্যাংকের হাতে থাকে ১০৭ টাকা ৮৩ পয়সা। এখন ওই ঋণ যদি আদায়ই না হয় আর সেটা যদি মন্দ মানের ঋণ হয় তাহলে ব্যাংকগুলো বছর শেষে আমানতকারীদের অর্থ কিভাবে ফেরত দেবে। এটা একেবারেই সোজা হিসাব। কিন্তু ব্যাংকগুলো নতুন আমানত নিয়ে পুরনো আমানত ফেরত দিতে আপাতত সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু দায়ের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলে আর কাক্সিক্ষত হারে

আমানত পাওয়া না গেলে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া অনেক কঠিন হবে। যেমনটি হচ্ছে কিছু ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এর ফলে একটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে অবসায়ন করা হয়েছে। এর আগে নতুন প্রজন্মের একটি ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় পর্ষদ ভেঙে দিতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটিকে রক্ষার জন্য ইতোমধ্যে সরকারি পাঁচটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে স্যালাইন হিসেবে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার মূলধন জোগান দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই গ্রাহকের আস্থায় আনা যাচ্ছে না।

এমনি পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতে মন্দমানের ঋণের লাগাম টেনে ধরতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। যারা ঋণ নিয়ে ব্যাংকের অর্থ বছরের পর বছর ফেরত দিচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। শ্রীলঙ্কার মতো সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। ঋণ আদায়ের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে যেকোনো রকম বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে না বলে ব্যাংকাররা আশঙ্কা করছেন।


আরো সংবাদ



premium cement