২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস

- ছবি : নয়া দিগন্ত

পেঁয়াজের বাজারে নজিরবিহীন অস্থিরতা দীর্ঘ তিন মাস ধরে। আর পুরো জাতি যখন পেঁয়াজ নিয়ে দুশ্চিন্তায় তখন নীরবে বেড়ে গেছে আরো অন্তত এক ডজন পণ্যের দাম। পেঁয়াজের পাশাপাশি বেড়েছে চাল, তেল, ডিম, আদা, রসুন, ময়দা, মরিচ, হলুদ, মসলা, চিনিসহ অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারসাজি করে এ কাজটি করছে। এর মাধ্যমে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী লাভবান হলেও সামগ্রিকভাবে দেশের সব জনগোষ্ঠীই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সীমাহীন বেকারত্ব, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে খরা, শেয়ারবাজারের দুরবস্থা, পরিবহন, বাসা ভাড়া ও শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যয়বৃদ্ধিসহ সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কবলে পড়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ভালো নেই দেশের ব্যবসায়ীরাও।

অভিযোগ উঠেছে, নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা তুলছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। দেশজুড়ে সব মানুষের নজর পেঁয়াজের দিকে। এ সুযোগে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এসব পণ্য কিনতে নিয়মিত বাড়তি ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতারা।

একই সাথে পেঁয়াজও কিনছেন ১৭০ থেকে ২২০ টাকায়। বর্তমানে বাজারে এসব পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। এর পরও বিভিন্ন অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছে অসাধু চক্র। সপ্তাহের ব্যবধানে মসলা পণ্য এলাচের দাম কেজিতে ৬০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। খুচরা বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি এলাচ বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়, যা টিসিবির তথ্যানুযায়ী আগের সপ্তাহে ছিল দুই হাজার ৪০০ টাকা।

খুচরা বাজারে এখন মিনিকেট চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকা, নাজিরশাইল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, আটাশ ৪০ টাকা, ঊনত্রিশ ৩৮ থেকে ৪০ টাকা, স্বর্ণা চাল ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগেও মিনিকেট চাল ৪১ থেকে ৪২ টাকা, নাজির ৫০ থেকে ৫২ টাকা, আটাশ ৩৩ থেকে ৩৪ টাকা, ঊনত্রিশ ৩২ থেকে ৩৩ টাকা, স্বর্ণা চাল ২৬ থেকে ২৭ টাকা ছিল।

নিত্যপ্রয়োজনীয় মসলা পণ্য শুকনা মরিচের দাম কেজিতে গড়ে ৫৫ টাকা এবং হলুদের দাম গড়ে ৩৫ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি শুকনা মরিচ মানভেদে ২২০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা দু’সপ্তাহ আগে ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা ছিল। এখন হলুদ বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২৫০ টাকায়, যা আগে ১৬০ থেকে ২০০ টাকা ছিল।

গতকাল খুচরায় প্রতি কেজি চীনা রসুন ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা ও দেশি রসুন ১৭০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়। দেশি পুরনো আদা ২০০ থেকে ২২০ টাকা ও নতুন আদা ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা এবং আমদানি করা আদায় ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা গুনতে হচ্ছে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য ঢালাওভাবে সব ব্যবসায়ীদের অভিযুক্ত করার প্রতিবাদ জানিয়ে খিলগাঁও রেলগেইট সংলগ্ন ফার্নিচার ব্যবসায়ী নূরুল আলম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ব্যবসায়ী মানেই মুনাফাখোর নয়। দেশের সব ব্যবসায়ী কারসাজির সাথে জড়িতও নয়। সরকারের আনুকূল্য নিয়ে অপকর্ম করছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। তার দায় নিতে হচ্ছে পুরো ব্যবসায়ী সমাজকে। তা ছাড়া পেঁয়াজের ব্যবসা করে যিনি বাড়তি টাকা আয় করছেন তাকে তো নিজের প্রয়োজনে চাল, ডাল, লবণ, তেল সবই কিনতে হচ্ছে। এমন অরাজকতা কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সংসার চালাতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে জানিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সোলায়মান খান গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, যে কোম্পানিতে চাকরি করি তার অবস্থাই ভালো না। গত তিন বছর ইনক্রিমেন্ট নেই। একই বেতনে চাকরি করছি। অথচ এসময়ে সংসার খরচ বেড়েছে প্রায় ৫০ পার্সেন্ট। লেখাপড়ার খরচ, বাসাভাড়া, চিকিৎসা ব্যয়, গ্যাস-বিদুতের বিল সবই বেড়েছে। তার ওপর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম তো আকাশছোঁয়া।
এভাবে চলতে থাকলে সব ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, গ্রামের অবস্থাও তো ভালো না। সেখানে আরো অরাজকতা চলছে। খারাপ মানুষ এবং অসাধূ উপার্জনকারী ছাড়া সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাই এখন দায় হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্যবসায়িক মন্দার অন্যতম প্রধান কারণ জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া। একজন সবজি বিক্রেতা সবজি বিক্রি করে ভালো আয়-রোজগার করলেও অপরাপর সব খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি আয়েও তার পক্ষে সরসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। দোকান ভাড়া বৃদ্ধি, বাসা ভাড়া বৃদ্ধি, কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি বেচাকেনা কমে যাওয়ায় তারা বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করেও আগের মতো লাভ করতে পারছেন না বলে জানান।

এদের অনেকের অবার আয় বেড়েছে ঠিকই; কিন্তু ব্যয় তুলনামূলকভাবে অধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়তি আয়েও সংসার চলছে না বলে জানান বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। টিকে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে অনেকে বড় ব্যবসা ছেড়ে ছোট ব্যবসায় যাচ্ছেন। অনেকে আবার পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে মেসে উঠছেন।

ব্যবসায়ীক মন্দার চিত্র চোখে পড়ে মার্কেটগুলোয় গেলেও। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিনিয়তই ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠত মার্কেটের দোকানিরাও। হাতবদলের পর কিছুদিন লোকসান গুনে নতুন দোকানিও গুটিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে। ফলে মার্কেট-মহল্লায় নতুন নতুন ব্যবসায়ীর সংখ্যাই বেশি চোখে পড়ছে।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন কম পুঁজির ব্যবসায়ীরা। তাদেরই একজন জীবনযুদ্ধে হীমসীম খাওয়া রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের ব্যবসায়ী সোলায়মান। ক্রোকারিজ মালামালের ব্যবসায় করেন তিনি।
কথা প্রসঙ্গে জানালেন, কয়েক মাস থেকে ব্যবসায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। বেচা-বিক্রি নেই বললেই চলে। স্কুলে সন্তানদের বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা শেষে শুরু হবে নতুন সেশনে ভর্তির চিন্তা। ভর্তি ফি, ড্রেস বানানো, বইপত্র কেনাসহ সম্ভাব্য খরচ কোত্থেকে জোগাড় করবেন সে বিষয়ে চরম দুশ্চিন্তার কথা জানালেন তিনি।

ব্যবসায় মন্দার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, গত রোজার ঈদের আগে থেকে যা বিক্রি হয় তাতে দোকান খরচই আসে না। বাসা ভাড়া, বাজার খরচ, চিকিৎসা ব্যয় এবং সন্তানদের পড়াশোর খরচ চলছে দোকানের পুঁজি ভেঙে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, দু-একটি ছাড়া অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যর দাম বৃদ্ধির যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এ ক্ষেত্রে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা দেখে অতিমুনাফার সুযোগ নিচ্ছে অন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা। পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের অসহযোগিতার কারণে দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।

এটি দেখে অন্য ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। এক কথায় নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। এটি কঠোরভাবে সরকারের দমন করা উচিত। এখন কঠোর পদক্ষেপ না নেয়া হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

ক্যাব সভাপতি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের চড়া দামের কারণে ভোক্তারা চাপে আছেন। বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষের কষ্ট অনেক বেড়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার যৌথভাবে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল