২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গ্রামে করোনাভাইরাস সংক্রমণ হঠাৎ বৃদ্ধির কারণ কী?

গ্রামের একটি বাজারে চায়ের দোকানের সামনে বসা কয়েকজন। - ছবি : সংগৃহীত

গত বছর বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই বেশিরভাগ সংক্রমণ শনাক্ত হয় মূলত ঢাকা এবং বিভাগীয় শহরগুলোতে। কিন্তু মাস দু’য়েক ধরে রাজধানীর তুলনায় প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতেই সংক্রমণের ব্যাপকতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কেন?

মাস দেড়েক আগে ঢাকা থেকে গাজীপুরের শ্রীপুরে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন নাসিমা আক্তার। এর ১৪ দিন পর করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা যায় তার মধ্যে।

পরে টেস্ট করলে নাসিমাসহ পরিবারের মোট পাঁচজনের দেহে শনাক্ত হয় এই ভাইরাস।

কিন্তু পরিবারে সংক্রমণের শুরুটা ঢাকা থেকে নাকি গ্রামে এসে - সেটা নিয়ে দ্বিধা রয়েছে এই পরিবারে।

নাসিমা আক্তার বলছেন, ‘আমরা আগে তো ঢাকায় ছিলাম। কয়েক মাস ধরে গ্রামে আসা-যাওয়ার মধ্যে আছি। দেড় মাস আগে সর্বশেষ যখন আসি, তখন কয়েক দফা সিএনজি পরিবর্তন করে আসতে হয়েছে।’

‘কিন্তু আমরা হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক ব্যবহার করেছি। সতর্কও ছিলাম। এখন সংক্রমণ ঢাকায় হয়েছে নাকি রাস্তায়, নাকি গ্রামে বুঝতে পারছি না।’

নাসিমার স্বামী সাইফুল ইসলাম অবশ্য মনে করেন, তার স্ত্রীর সংক্রমণ হয়তো গ্রামে আসার পরই হয়েছে।

কারণ তার ভাষায়, গ্রামে অনেকের মধ্যেই করোনাভাইরাসের উপসর্গ আছে।

‘এখানে অনেক বাড়িতেই সর্দি-জ্বর। কেউ টেস্ট করে না। আমাদের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এইখানেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, ঢাকা থেকে আসার ১৪ দিন পর আমার স্ত্রীর উপসর্গ দেখা দিয়েছে।’

এক মাসে সংক্রমণ কয়েকগুণ
শ্রীপুরে এপ্রিল-মে মাসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ১০ শতাংশের নিচে। জুন মাসে ১৫ শতাংশ। আর জুলাইয়ের ২৭ তারিখ পর্যন্ত সেটা কয়েকগুণ বেড়ে হয় ৬০ শতাংশ।

গ্রামে সংক্রমণের হঠাৎ এই বৃদ্ধির কারণ কী? এর উত্তর খুঁজতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না।

এলাকার হাট-বাজারগুলোতে ঢুঁ মারতেই দেখা গেল লকডাউনের মধ্যেও মানুষের জটলা এবং সংক্রমণ বৃদ্ধির মধ্যেই মাস্কবিহীন ঘোরাফেরার দৃশ্য।

স্থানীয় একটি বাজারে দেখা গেলো, একটি চায়ের দোকানে কাঠের দুটো বেঞ্চিতে ঘেঁষাঘেষি বসে আছেন অন্তত ১৫ জন।

দোকানের টিভিতে চলছে বাংলা সিনেমা। উপস্থিত কারো মুখে মাস্ক নেই।

লকডাউনের মধ্যে বাইরে এভাবে জটলা করে আড্ডা দেয়ার কারণ কী - জানতে চাইলে একজনের সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘বাসায় আর কতক্ষণ বইসা থাকা যায়?’

দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রসঙ্গে তার দাবি, তারা দূরত্ব মেনেই বসেছেন এবং মাস্ক ব্যবহার করেন। যদিও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন।

এছাড়া লকডাউন চললেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট খোলা। ক্রেতাদের আনাগোনাও বেশ। সবখানেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা দেখা গেল।

কিন্তু সংক্রমণ বাড়ার পেছনে শুধুই কি অসচেতনতা?

এই উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রণয় ভূষন দাস অবশ্য মনে করেন, ঈদ এবং লকডাউনের আগে-পরে মানুষের শহর-গ্রাম আনাগোনা এবং সংক্রমণ গোপন রেখে চলাফেরার কারণে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটেছে।

‘এখানে মানুষের মধ্যে মুভমেন্ট হচ্ছে। অনেকে শহরে যাচ্ছে, আবার গ্রামে আসছে। অনেকের মধ্যে উপসর্গ থাকলেও সেটা গোপন করে চলাফেরা করে যাচ্ছে। ফলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরো বেশি ছড়াচ্ছে।’

তবে শ্রীপুরে সংক্রমণ জুলাই মাসে বাড়লেও বাংলাদেশে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে সংক্রমণ বৃদ্ধির শুরুটা হয় মূলত মে মাসে যখন বাংলাদেশে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

কেন গ্রামের লোকজন ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ছুটছে?
শুরুতে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ ছড়ালেও পরে খুব দ্রুতই সংক্রমণ বেড়েছে সারাদেশে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের গেল দুই সপ্তাহের তথ্যে দেখা যায়, ৫০ শতাংশের উপরে সংক্রমণের হার এমন শীর্ষ ১০টি জেলার সবগুলোই ঢাকার বাইরে এবং এর বেশিরভাগটাই রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, কুষ্টিয়া, বরিশাল, কুড়িগ্রামের মতো দূরের জেলা।

এছাড়া অনেক জেলাতেই সংক্রমণ বেশি মূলত গ্রামীণ এলাকায়। যেমন মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলা। পুরো জেলায় যেখানে গেলো দুই সপ্তাহে সংক্রমণ ৪০ শতাংশ, সেখানে লৌহজং উপজেলায় সংক্রমণ প্রায় ৫০ শতাংশ।

গ্রামে এভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় সেটা স্থানীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করছে।

লৌহজং উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নূর-এ-আলম বলছেন, করোনা সংক্রমিতদের যাদের চিকিৎসা প্রয়োজন তারা মূলত যাচ্ছেন ঢাকায় কিংবা জেলা সদরের কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে।

‘আমাদের এখানে হাই ফ্লো অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। আইসিইউ নেই। সুতরাং রোগীদের যাদের অবস্থা একটু খারাপ, তারা এখানে আসবে না এটাই স্বাভাবিক।’

‘আবার সাধারণ যেসব রোগী আসছে, তাদের নিয়েও আমাদের হিমশিম অবস্থা। কারণ, আমাদের ডাক্তার এবং অন্যান্য জনবল কেউই কোভিড ডেডিকেটেড নয়। ফলে একই জনবল কোভিড এবং নন-কোভিড সবার চিকিৎসায় কাজ করছে। এটা বেশি ঝুঁকি তৈরি করছে।’

দেখা যাচ্ছে, গ্রামে সংক্রমণ বাড়লেও সেখানে যথেষ্ট স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। ফলে ঢাকায় রোগীর চাপ বাড়ছে।

খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী কয়েকদিন আগে জানিয়েছেন, ঢাকার হাসপাতালগুলোতে যেসব করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ভোর্তি আছেন, তাদের ৭৫ শতাংশই গ্রাম থেকে আসা।

আবার এসব রোগীদের একটা বড় অংশ শেষ সময়ে হাসপাতালে আসায় মৃত্যুও বাড়ছে।

কিন্তু এরপরও সাধারণ মানুষের মধ্যে মাস্ক পরা কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতায় ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। আর শঙ্কাটা এখানেই।

সূত্র : বাসস


আরো সংবাদ



premium cement