২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কেন এত চিকিৎসক করোনাক্রান্ত?

কেন এত চিকিৎসক করোনাক্রান্ত? - প্রতীকী ছবি

‘একজনের মৃত্যু একটি ট্র্যাজেডি। যখন মৃত্যুসংখ্যা লাখ ছাড়ায়, তখন তা শুধুই পরিসংখ্যান।’

মাস দুয়েক আগে ফেসবুকে এমন একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের মেধাবী তরুণ চিকিৎসক মাহমুদ মনোয়ার। সৎচিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি ছিল তার। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। আজ নিজেই তিনি পরিসংখ্যানের একটি সংখ্যা মাত্র। 
বিখ্যাত চিকিৎসক ও শিক্ষক অধ্যাপক এন আই খান। হাজার হাজার চিকিৎসক গড়ার কারিগর তিনি। তরুণ মেধাবী চিকিৎসক সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মঈন উদ্দীন আহমেদ। বহু দিনের সাধনার পর এফসিপিএস পাস করে প্রমোশন পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হয়েছেন খুব বেশি দিন হয়নি। ভেবেছিলেন কতগুলো বছর রাতদিন এক করে পড়াশুনা করেছেন, কারো দিকে নজর দেয়া হয়নি। এবার পরিবারের দিকে মনোযোগ দিবেন। সন্তানদের সময় দিবেন। একেই বলে নিয়তি। আজকে তার সন্তানদের কী অবস্থা খোঁজ নেয়ার কেউ নেই।

এভাবে মৃত্যুর তালিকায় একের পর এক যুক্ত হচ্ছেন চিকিৎসকরা। প্রতিদিনই তালিকা বড় হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত ৪৮ জনে ঠেকেছে। কত বড় হবে এ তালিকা তা আল্লাহই বলতে পারেন।

এর সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে করোনা পজিটিভ হওয়া চিকিৎসকের তালিকা। এ পর্যন্ত হাজারের ওপর ছাড়িয়েছে। 
কেন এমন হচ্ছে, এর কারণ খুঁজতে বেশ কিছু চিকিৎসকের সাথে কথা বলেছে নয়া দিগন্ত। সঙ্গত কারণেই নাম প্রকাশ করতে চাননি তারা। 
করোনা সংক্রমণ যখন শুরু হয় তখন সরকার থেকে বারবার প্রস্তুত বলা হলেও আসলে কিছু চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেয়ার মধ্যেই তা সীমিত ছিল। এ জন্য মাস্ক নিয়ে বিশাল কাণ্ড হয়েছে! তত দিনে চিকিৎসকদের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন। এখন যদিও বলা হচ্ছে পিপিই সরবরাহ করা হয়েছে কিন্তু তা করোনা ইউনিটে কাজ করাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আবার করোনা ইউনিটে চিকিৎসা করা চিকিৎসকদেরও কিন্তু প্রয়োজন মতো জিনিসপত্র দেয়া হচ্ছে না। 

ঢাকা মেডিক্যালের করোনা ইউনিটে কাজ করা একজন চিকিৎসক বলেন, ৬টি ডিউটি করার জন্য আমাদের এন৯৫ মাস্ক দেয়া হয়েছে ২টি, কেএন৯৫ মাস্ক ৫টি। যে কেএন৯৫ মাস্ক দেয়া হয়েছে সেগুলো পরে করোনা রোগীর কাছে যাওয়া মানে যমদূতের সাক্ষাৎ করা। এন৯৫ দুটো দিয়ে ২ দিন ডিউটি করা যায় কিন্তু বাকি দিন তো ডিউটি করা যায় না। তাই তিনি নিজের টাকায় প্রতিটি সাড়ে আট শ’ টাকা করে ৫টা এন৯৫ কিনেছেন। তিনি আরো যোগ করেন, তার গ্রুপে এক চিকিৎসক এন৯৫ মাস্ক কিনতে না পারায় সরকারিভাবে সরবরাহ করা কেএন৯৫ মাস্ক পরে ডিউটি করেন। তাদের চারজনের মধ্যে ওই চিকিৎসক এখন করোনা পজিটিভ। 

ঢাকা মেডিক্যালে কাজ করা আরেকজন চিকিৎসক বলেন, আমাদের নিজেদের প্রটেকশনের জন্য প্রতিবার ডিউটির আগে কমপক্ষে ৫ হাজার টাকার জিনিসপত্র কিনতে হয়। এমনিতে ইনকাম নেই তার ওপর এ খরচ তো কষ্টের কারণ হয়ে গেছে।
ওই চিকিৎসক জানান, তাদের ব্যাচের ৮০ জন চিকিৎসকের মধ্যে ৩০ জন করোনা আক্রান্ত। এভাবে চলতে থাকলে চিকিৎসা করবে কে?
মুগদা মেডিক্যাল কলেজেও চিকিৎসকদের মধ্যে করোনা আক্রান্তের হারও বেড়ে চলেছে। গেল সপ্তাহে অনেক চিকিৎসক ডিউটিকালীন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। 

করোনা ওয়ার্ডে ডিউটি পালন করা কয়েকজন চিকিৎসক জানান, ওয়ার্ডগুলোর অব্যবস্থাপনার জন্যই চিকিৎসকরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। ওয়ার্ডগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না। রোগীর লোকদের সমাগম অনেক। এটা সাধারণ কোনো রোগ নয়, তারা বুঝতেই চান না। এ জন্য রোগী দেখতে আসা প্রায় সবাই আক্রান্ত হন। রোগীর লোকেরা সারা হাসপাতাল ঘুরে বেড়ায়। তারা সর্বত্র করোনা ছড়িয়ে দেন।
অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে ডফিং রুম (ডিউটি করার পর চিকিৎসকরা এখানে পিপিই খোলেন) চিকিৎসকদের আক্রান্ত করার অন্যতম স্থান। কারণ এখানে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত পিপিই থাকে। এ জন্য ডফিং রুম প্রতিবেলা পরিষ্কার করা দরকার। কিন্তু কোভিড হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডফিং রুম পরিষ্কার করা হয় না বললেই চলে। বারবার বলার পরও তা পরিষ্কার করা হয় না। আবার কোনো কোনো হাসপাতালে ডফিং রুম ওয়ার্ডের মধ্যে হওয়ার কারণে ঝুঁকি আরো বেশি।

চিকিৎসকদের আনা-নেয়ার জন্য যে গাড়ি ব্যবহার করা হয় তাতেও আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি। একটি গাড়িতে চাপাচাপি করে যাতায়াত করতে হয়। এতে কোনো একজন আক্রান্ত হলে অন্যদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি সৃষ্টি হয়। চিকিৎসকদের থাকার ব্যবস্থা আবাসিক হোটেলগুলোও হতে পারে আক্রান্তের স্থান। কোনো কোভিড আক্রান্ত চিকিৎসকের কক্ষ ছেড়ে দেয়ার দিন থেকেই অন্য একজন চিকিৎসক থাকতে শুরু করেন। ফলে তিনি সহজেই আক্রান্ত হন। কিভাবে হোটেলের কক্ষগুলো জীবাণুমুক্ত করা যায় তা জানে না হোটেলগুলো। 

অনেক চিকিৎসকের সাথে কথা বলে জানা গেছে যারা নন-কোভিড হাসপাতালে বা কোভিড হাসপাতালের নন-কোভিড অংশে কাজ করছেন তারা নিজের অজান্তেই আক্রান্ত হচ্ছেন। কারণ তারা যে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন সে রোগীরা কোরোনা আক্রান্ত কি না বুঝতে পারছেন না। রোগীরাও নিজে বা পরিবারের কেউ করোনায় আক্রান্ত কি না তা গোপন রেখে ঝুঁকিতে ফেলেন চিকিৎসকদের। এসব চিকিৎসক কোভিড ইউনিটে কাজ করা চিকিৎসকদের থেকে সুরক্ষা ব্যবস্থা কম নেন। এবং সরকারিভাবে তাদের সুরক্ষাসামগ্রী দেয়া হয় না বললেই চলে। আক্রান্তের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগের চিকিৎসকরা। তাদের মধ্যে আক্রান্তের হারও বেশি। কিন্তু তাদের জন্য নেয়া হয়নি আলাদা কোনো ব্যবস্থা।
সবচেয়ে হতাশার ব্যাপার হলো বাজারে নকল মাস্কে সয়লাব হয়ে গেছে। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী বেশি দামে নকল মাস্ক বিক্রি করছে। চিকিৎসকদের কয়েকটি গ্রুপে এটা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা দেখা যায়। সে গ্রুপ থেকে জানা যায় লিটন নামের একজন ব্যবসায়ী সারা দেশে নকল মাস্ক সরবরাহ করছেন। কিন্তু শুধু লিটনই নয় এমন হাজারো অসাধু ব্যবসায়ী আছেন। চিকিৎসকরা বেশি পরিমাণে আক্রান্তের অন্যতম কারণ এটা বলে মনে করছেন অনেকেই। ফেসবুকে অনেক চিকিৎসক লিখেছেন দামি এন৯৫ মাস্ক, ভালো পিপিই পরার পরও তারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। 

কোভিড ইউনিটে কাজ করার পরও বেতন পাননি ৩৯ বিসিএসে যোগদানকারী চিকিৎসকরা। এটা নিয়ে তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। 
বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ক্ষোভের সাথে জানান, শুধু আমাদের ডিউটি রোস্টার করে দিয়েই কাজ শেষ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। ওয়ার্ডগুলো চলছে কিভাবে তার কোনো খোঁজ নেন না। বেশির ভাগ ওয়ার্ডে ওয়ার্ডবয় থাকে না, থাকলেও যারা আছে তারা নতুন বলে কিছুই জানে না। নার্সদের বেশির ভাগই নতুন নিয়োগ পাওয়া। ওয়ার্ডে ইসিজি মেশিন নষ্ট। অক্সিজেনের লাইনে সমস্যা। কিন্তু দেখার কেউ নেই। এত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার পরও প্রশাসনের একটি গ্রুপ থেমে নেই। তারা চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছে। সরকার কোভিড ইউনিটে কাজ করা চিকিৎসকদের আবাসনের ব্যবস্থা করে চিকিৎসকদের উৎসাহিত করেছে। কিন্তু তারা এটা বাতিলের পাঁয়তারা করছে।


আরো সংবাদ



premium cement