২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নারায়ণগঞ্জকে বাংলাদেশের ‘এপিসেন্টার’ মনে করছে আইইডিসিআর

নারায়ণগঞ্জকে বাংলাদেশের ‘এপিসেন্টার’ মনে করছে আইইডিসিআর - ছবি : সংগৃহীত

করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর এক মাস পরে এসে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে না পারলে এ ভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশকে বিপদজনক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ পরিস্থিতিতে দেশে লকডাউন আরো কঠোর করা এবং সাধারণ ছুটি বাড়ানোরও প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের একমাসের মাথায় পর পর কয়েকদিন টানা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের দেহে এ ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গেছে।

বৃহস্পতিবার একদিনে সহস্রাধিক মানুষকে পরীক্ষা করে ১১২ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত সপ্তাহের ৬ দিনে ২৬৯ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন বাংলাদেশে।

এ পর্যায়ে সংক্রমণ ঢাকাসহ দেশের অন্তত ২১টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানাচ্ছে রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আইইডিসিআর। এছাড়া চারটি জেলায় একাধিক ক্লাস্টারে কমিউনিটি সংক্রমণ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি কমিউনিটি সংক্রমণ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ জেলায়।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আইইডিসিআর এর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ এখন ক্লাস্টারের চেয়ে বেশি কিছু এটি এখন বাংলাদেশে সংক্রমণের এপিসেন্টারে পরিণত হয়েছে।’

‘ঢাকার মধ্যে টোলারবাগসহ পুরো মিরপুরেই আমরা রোগী পাচ্ছি, এছাড়া ওয়ারি, বাসাবো এলাকায় সংক্রমণ পাচ্ছি বেশি। তবে ক্লাস্টারগুলোর মধ্যে গাইবান্ধায় সংক্রমণ বাড়েনি। কিন্তু মাদারীপুরে কয়েকজন রোগী সেরে ওঠার পর আবার সংক্রমিত হওয়াটা চিন্তার বিষয়।’

জাতিসংঘ এইচআইভি/এইডস সেকশনের প্রধান কর্মকর্তা ও বৈশ্বিক সমন্বয়ক ডা. মনিকা বেগ বাংলাদেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি শুরু থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন।

বর্তমান সংক্রমণের অবস্থা বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন একদম উঠছি উপরে। খুব তাড়াতাড়ি। আমার মনে হয়না যে এটা আর ক্লাস্টারের মধ্যে থাকছে।’

তিনি বলেন, এটা হয়তো আরো আরো বিস্তৃতি লাভ করছে। আমার কাছে মনে হয় আমরা এখন ওই পর্যায়ে আছি যেখানে আমাদের কেইস বাড়তেই থাকবে। এখন এটা নিয়ন্ত্রণে আনার একমাত্র রাস্তা হচ্ছে এখন বাড়িতে থাকা, প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং টেস্টিং বাড়ানো।

ডা. মনিকা বেগ মনে করেন বেশি বেশি টেস্ট করে আক্রান্ত সবাইকে খুঁজে বের করে আলাদা করতে হবে না হলে চিকিৎসা ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।

বাংলাদেশে পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘অন্যান্য দেশগুলোতে যেভাবে বাড়ার ধরনটা ছিল বাংলাদেশেও মনে হয় সেই বৃদ্ধির ধরনটাতে প্রবেশ করলো।’

‘বৈশ্বিক যে রেশিও [হার] করোনাভাইরাসের ২.৫ সেটা যদি ধরি তাহলে সামনের দিনগুলোতে আরো কেইস বাড়বে। এটা সারা দেশজুড়েই হবে।’

‘আর আমরা যেহেতু ভালোমতো কোয়ারেন্টিনটা করতে পারেনি। এমনকি আমরা যে লকডাউনের কথা বলছি বা সোশ্যাল ডিসটেন্সিংয় সেখানেও যেহেতু বেশকিছু ঘাটতি থেকে যাচ্ছে, সুতরাং সামনে আমাদের একটা বড়সড় আউটব্রেক হতে থাকলে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।’

কতদিনের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত হতে পারে?
অন্যদিকে চীনের পর যেসব দেশে ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে সেখানে প্রথম সংক্রমণের পর ৩৮ থেকে ৭৬ দিনের মাথায় একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ শনাক্ত হতে দেখা গেছে।

আক্রান্ত শনাক্তের সংখ্যা যদিও নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা নির্ভর করলেও দেখা যাচ্ছে মোটামুটি প্রথম সংক্রমণের এক দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে বেশিরভাগ দেশে সংক্রমণ চূড়ায় উঠেছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমনে বিশ্বে বর্তমান ‘এপিসেন্টার’ হিসেবে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্রে চার লাখের বেশি আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম করোনা রোগি শনাক্ত হওয়ার এক মাস পর একদিনে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল মাত্র ২০ জন। সংক্রমণ শুরুর ৭৬ দিনের মাথায় একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত পাওয়া গিয়েছে ৩২ হাজার ১০৫ জন।

স্পেনের প্রথম শনাক্তের এক মাসের মাথায় একদিনে সংক্রমণ ছিল মাত্র ১৩ জন। সেখানে ৬১ দিনের মাথায় সর্বোচ্চ শনাক্ত হয় একদিনে ৯ হাজার ২২২ জন।

মৃত্যুর সংখ্যায় শীর্ষে থাকা ইতালিতে একমাসের মাথায় একদিনে সংক্রমিত পাওয়া যায় ২৩৮ জন আর ৫৩ দিনের মাথায় একদিনে সর্বোচ্চ ৬হাজার ৫৫৭ জন রোগি শনাক্ত হয়।

ইরানে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার একমাস পূর্তীর দিন শনাক্ত হয়েছিল ১ হাজার ৪৬ জন। দেশটিতে ৪২ দিনের মাথায় সর্বোচ্চ শনাক্ত হয় একদিনে ৩ হাজার ১৮৬ জন।

আর যুক্তরাজ্যে একমাস পরে একদিনে যে সংক্রমণ ছিল ২০ জন সেখানে ৬৭ দিনের মাথায় একদিনে সর্বোচ্চ রোগি শনাক্ত হয়েছে ৫ হাজার ৯০৩ জন।

বিশ্লষকরা বলছেন, বাংলাদেশেও যেহেতু সামাজিক সংক্রমণ শুরু হয়েছে তাই মহামারি ধর্ম অনুযায়ী এখানেও সংক্রমণ চূড়ায় উঠবে।

কিন্তু কবে এটি হবে, তা নিয়ে এখনো কোনোকিছু বলতে চাইছে না আইইডিসিআর।

তবে ডা. বে-নজির আহমেদ ধারণা করছেন, এ মাসের শেষদিকে বাংলাদেশে সংক্রমণ পিক বা চূড়ায় উঠতে শুরু করতে পারে- ‘আমরা ধরে নিতে পারি যে এপ্রিলের শেষ দিকে আমরা বুঝতে পারবো যে পিকটা কখন হতে পারে। এটা মে মাসের প্রথম দিকে বা মে'র মাঝামাঝি হতে পারে।’

ভ্যাকসিন কতদূর?
করোনা ভাইরাস মারত্মক ছোয়াঁচে এবং এটির কোনো চিকিৎসা এখনো নেই। করোনাভাইরাসে পুরো পৃথিবীতে অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতি বিপর্যস্ত হাজারো মানুষের প্রাণ যাচ্ছে প্রতিদিন। এ ভাইরাস থেকে মুক্তিপেতে চিকিৎসা বা ভ্যাকসিন আবিস্কার নিয়ে বিজ্ঞানীরা কী করছেন সেটি জানতে চেয়েছিলম ডা. মনিকা বেগের কাছে।

তিনি জানান, ‘রেকর্ড টাইমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটা ট্রিটমেন্ট ট্রায়াল শুরু করেছে ৭০টি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে। ট্রায়ালটার নাম হচ্ছে সলিডারিটি। চারটা ট্রিটমেন্ট প্রটোকলকে টেস্ট করা হচ্ছে।’

‘আশা করছি আমরা তাড়াতাড়ি একটা ট্রিটমেন্ট প্রটোকল হাতে পাব আমরা, এটা এক নম্বর। আর একই সাথে সারা দুনিয়াতে ২০টার মতো প্রতিষ্ঠান নানারকম ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালাচ্ছে। সেটা আশা করা হচ্ছে ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে হয়তো আমরা পেয়ে যাব।’

তিনি জানান, ‘আমাদের হাতে যদি একটা ভ্যাকসিন চলে আসে এবং তার আগে যদি একটা যথাযথ চিকিৎসা চলে আসে তাহলে এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। কিন্তু এটা কতদিনে সেটা বলা মুশকিল!’

কিন্তু এ ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা না আসা পর্যন্ত করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই বলেও জানান মনিকা বেগ।

এই মুহূর্তে করোনা মহামারি মোকাবেলায় বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি এবং বেশকিছু জায়গায় লকডাউন চলছে। প্রতিদিন সংক্রমণ বাড়তে থাকায় বোঝাই যাচ্ছে বাংলাদেশে লকডাউন আরো কঠোর এবং দীর্ঘস্থায়ী হতে যাচ্ছে। আইইডিসিআর সুনির্দিষ্ট করে না বললেও ধারণা দিয়েছে যে বাংলাদেশে লকডাউন এবং ছুটি আরো বাড়ানোর প্রয়োজন হবে। সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement