১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার দ্রুত চাপে পড়বে : প্রত্যাশা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

মিয়ানমারে নির্যাতন থেকে বাঁচতে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় - সংগৃহীত

বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে গত সাত বছর ধরে বহু চেষ্টা-চরিত্র ও প্রচুর আলোচনা হলেও বাস্তবে কার্যত একজনকেও প্রত্যাবাসন করা যায়নি। তার ওপর মিয়ানমারে এই মুহূর্তে অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির কারণে এই প্রত্যাবাসন এখন আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলেই আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা।

যদিও এই সমস্যা সমাধানে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে করা মামলায় দ্রুত একটি ‘পজিটিভ আউটকাম’ আসবে বলে মনে করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। এতে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

একইসাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং চীনকে যুক্ত করলে ‘সমাধান সম্ভব’ বলেও তিনি মনে করেন।

যদিও দেশটির অভ্যন্তরীণ সঙ্কট বা জাতিগত সঙ্ঘাত যাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আরো বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

রোববার ঢাকায় প্রেসক্লাবে ওভারসিজ করেসপন্ডেন্ট অব বাংলাদেশের (ওকাব) এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এসব মতামত উঠে এসেছে।

বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সংগঠন ওকাব।

অনুষ্ঠানে প্রশ্ন উঠেছে সাত বছর পরও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া আর কতদূর? তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক যে অর্থ সহায়তা পাওয়া যায়, তা কমে আসা নিয়ে সরকারের উদ্যোগই বা কী?

রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সঙ্কটকে অন্য কোনো সঙ্কটের সাথে তুলনা করা যাবে না।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সরকারকে আরো মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

‘যথাযথ ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন’
সেমিনারের মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশের বার্তাসংস্থা ইউএনবির সম্পাদক ফরিদ হোসেন উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে শুরুতে যেভাবে আলোচনা হতো এখন তা অনেকটাই কমে এসেছে।

ফলে অদূর ভবিষ্যতে তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

ফরিদ হোসেন বলেন, ‘দেশে এখন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশ তাদের প্রত্যাবাসনের চেষ্টায় মিয়ানমারের সাথে আলোচনা করলেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি।’

তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ কূটনৈতিক ও আইনি দুই প্রক্রিয়াতেই এগোচ্ছে বলে জানান।

তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া এখনো চলমান। এ বিষয়ে এখনো সমঝোতা প্রক্রিয়া চলছে। গত বছর প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য কূটনৈতিক পথটাকেই অনুসরণ করছি। একই সাথে আন্তর্জাতিক আদালতেও গেছি। গাম্বিয়ার মাধ্যমে মামলা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতে যতটুকু আউটকাম এসেছে তা আমাদের পক্ষেই এসেছে।’

এখনো পর্যন্ত এ মামলার যে রায় এসেছে তা বাংলাদেশের পক্ষে রয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি আশা প্রকাশ করেন, ‘খুব দ্রুতই এই মামলার একটা পজিটিভ আউটকাম আসবে। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে একটা চাপ মিয়ানমারের ওপর পড়বে।’

আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর যেসব দেশের প্রভাব আছে ক্রমাগত তাদের এ বিষয়ে যুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমাদের রিজিওনাল পাওয়ারগুলোর গুরুত্ব অনেক। এখানে ভারত ও চীনের ভূমিকা অত্যন্ত মুখ্য। তাদেরকে আরো বেশি করে এনগেজ করতে পারলে বিশ্বাস করি যে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।’

উগান্ডায় মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে একটি দ্বি-পক্ষীয় বৈঠকের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিটিসিজম (সমালোচনা) এড়ানোর জন্য তারা অন্তত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায়। তার কথাতে এটা আমার মনে হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইনে এখন যে পরিস্থিতি ... তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। যেখানে তাদের সিকিউরিটি ফোর্স এখানে পালিয়ে আসছে এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের সেখানে ঠেলে দিতে পারি না।’

তবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই এই সমস্যার একমাত্র সমাধান বলে মনে করেন হাছান মাহমুদ। তবে তার মতে, সেটি হতে হবে ‘যথাযথ ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন’।

তবে পাশ্চাত্যের কিছু দেশ রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে যারা এখনো মিয়ানমারে আছে তারাও উন্নত দেশে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিচ্ছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘১৩ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে মাত্র কয়েক শ’ রোহিঙ্গাকে কানাডা, ইউকেতে নেয়া হয়েছে। তারা তো সবাইকে নিচ্ছে না।’

আন্তর্জাতিক চাপ যদি চলমান থাকে ও আন্তর্জাতিক আদালতের রায় যদি পক্ষে থাকে তখন মিয়ানমার প্রত্যাবাসন শুরু করতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সবসময়ই জাতিগত সঙ্ঘাত ছিল। তাই এই জাতিগত সঙ্ঘাতকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করার বিষয়ে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো উচিত নয়। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেই প্রক্রিয়া শুরু হওয়া প্রয়োজন।’

যা বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা
সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাবনার কথা বলা হলেও আপাতত আগামী দু’বছরেও প্রত্যাবাসনের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।

তারা বলছেন, মিয়ানমারে প্রতিদিনই কোনো না কোনো শহর বিদ্রোহীরা দখল করছে। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে। ফলে এমন পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি তাতে দু’বছরের মধ্যে প্রত্যাবাসনের কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। একটু আগেই সংবাদে পড়লাম, রোহিঙ্গাদের বেশ শক্ত ঘাঁটি বুথিডং এর পতন হয়েছে। এটা মংডুর একটা উপশহর, খুব নিরাপত্তায় ঘেরা ছিল।’

তিনি বলেন, ‘বুথিডং ফল করার মানে হচ্ছে এরপর মংডু ফল করা। এই জায়গাগুলোতেই মূলত যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে তাদের ম্যাক্সিমামের বাস ছিল। সেখানে বুথিডং বা মংডুর যদি যে কোনো সময় পতন ঘটে তবে কাদের সাথে আলোচনা করবে ‘

তার মতে, প্রতিদিনই আসলে মিয়ানমারের একের পর এক শহরের পতন ঘটছে।

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘রাখাইন রাজ্য, চিন রাজ্য থেকে শুরু করে শান- সর্বত্রই প্রতিদিন ছোট-বড় শহরের পতন হচ্ছে। ফলে আমি তো কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। শুধুমাত্র একটা শহরে তো নয়, পুরা মিয়ানমার জুড়ে সিভিলওয়ার শুরু হয়েছে। ফলে এটা চিন্তা করলে তো হবে না আগামী এক বছরে শেষ হয়ে যাবে। কারণ এখনো ঠিক মতো যুদ্ধ শুরুই হয়নি। আবার আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের লাগিয়েছে। তারাও চেষ্টা করছে বুথিডং, রথিডং, মংডুতে থাকতে। সেখানে থাকতে হলে তো তাদের আরাকান আর্মিকে শক্তি দেখাতে হবে। সেটা তো করছে বলে রিপোর্ট পাচ্ছি।’

ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আপাতত সমঝোতার কোনো পথ নেই বলে মনে করছেন তিনি।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, এই সঙ্কট সমাধানে যে কোনো ক্ষুদ্র কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকেও ছোট করে দেখা যাবে না। বহুমুখী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এক্ষেত্রে জরুরি।

সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘দেশটির অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সামরিক জান্তা বাহিনীর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কক্সবাজারে থাকা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এখন বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই যে কোনো ধরনের কূটনৈতিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে।’

অর্থ সহায়তা বাড়বে বলে আশা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা আশঙ্কাজনকভাবে কমে এলেও এ বছর থেকে তা আবার বাড়ছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

তিনি বলেন, ‘গত বছর ফান্ডিং একেবারেই কমে গিয়েছিল। আগে একজন রোহিঙ্গার জন্য মাথাপিছু ১২ ডলার বরাদ্দ ছিল। কিন্তু তা কমে একেবারে আট ডলারে নেমে গিয়েছিল। তবে এ বছর থেকে আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। এটি এখন ১০ ডলারের বেশি, এটি ১১ ডলারও হতে পারে।’

তিনি জানান, ‘ফান্ডিংটা ঠিকমতো পাওয়াও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজার যুদ্ধের পর ওয়ার্ল্ড ফোকাসটা সরে গিয়েছিল। ২০২১ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্রাইসিসে ফোকাস ছিল। কিন্তু সেটা এখন আর নেই। সে কারণে ধপাস করে ফান্ডিং কমে গিয়েছিল। তবে এ বছর সরকারের অনেক চেষ্টায় ফান্ডিং ১০ ডলারের ওপর বেড়েছে। প্রতি বছর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ৩৫ হাজার শিশু জন্ম নেয়। ফলে ফান্ডিং খুব জরুরি।’

বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে এই সমস্যা সমাধানে এ বছরের মার্চে জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের (জেআরপি) উদ্বোধন করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধির আহ্বান করা হয়।

এই জেআরপির মাধ্যমে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ এবং ভাসানচরে থাকা ১৩ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ৮৫২ দশমিক চার মিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়।

জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন সংস্থা, বাংলাদেশী ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ ১১৭টি সংস্থাকে জেআরপি একত্রিত করেছে। প্রতিবছর বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য এক দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement