২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ইরাক-ইরান-তুরস্ক হয়ে ভয়ঙ্কর ইউরোপ যাত্রায় বহু বাংলাদেশী

ইরাক-ইরান-তুরস্ক হয়ে ভয়ঙ্কর ইউরোপ যাত্রায় বহু বাংলাদেশী - ছবি : সংগৃহীত

ইউরোপ। বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের অভিবাসনপ্রত্যাশীদের স্বপ্নের মহাদেশ। তাই ইউরোপের দেশগুলোতে ঢুকতে জীবনবাজি রাখতেও কার্পণ্য করেন না তারা। ভূমধ্যসাগরে মাঝে মধ্যেই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটছে। হতাহত হচ্ছে অসংখ্য অভিবাসী। ইউরোপে প্রবেশের নানা অবৈধপথ বেছে নেন দালালরা। তাদের খপ্পড়ে পড়ে জীবনবাজির পথ বেছে নেন অভিবাসীরা। এরকমই একটি নতুন চোরাগোপ্তা পথ আবিষ্কার করেছে দালালরা। ইরাক থেকে ইরান, সেখান থেকে তুরস্ক। এরপর তাদের কথিত ‘গেইম’র মাধ্যমে ঢুকানো হয় ইউরোপের দেশ গ্রিসে। মূলত এই পথে ইউরোপে প্রবেশে দালালরা তুরস্ক ও গ্রিসকেই ব্যবহার করে। এতে কেউ সফল হয়, কেউবা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে আটক হয়ে ফিরে আসতে হয়। মাঝখান থেকে লাভবান হচ্ছেন বাংলাদেশ, ইরাক, ইরান ও তুরস্কে গড়ে ওঠা দালালচক্র।

ইরাক থেকে ইরান ও তুরস্ক হয়ে কিভাবে ইউরোপের দেশ গ্রিসে ঢুকছেন অভিবাসীরা? এই যাত্রা যে খুব সহজ নয়, তা উঠে এসেছে এই পথের দুই যাত্রী কামাল মাহমুদ ও আব্দুল আলিমের বয়ানে। তাদের প্রথমজন এখন ইউরোপে ঢোকার স্বপ্নে তুরস্কে রয়েছেন। আর আব্দুল আলিম গ্রিসে ঢুকেও ভাগ্যদোষে ফের ইরাকেই ফিরতে হয়েছে। ইউরোপযাত্রায় সীমাহীন দুর্ভোগ আর ভয়ঙ্কর সব পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে তাদের। কিভাবে তারা এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিলেন? তারই বর্ণনা দিয়েছেন কামাল মাহমুদ ও আব্দুল আলিম।

চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করা কামাল মাহমুদ সাড়ে চার বছর আগে ইরাকের বাগদাদে যান। বয়স তখন ১৬ হলেও ২৩ বছরের পাসপোর্ট বানিয়ে ওয়ার্ক ভিসায় ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর প্রবাসজীবন শুরু হয় মুুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর সদর উপজেলার মোল্লাকান্দি ইউপির মুন্সীকান্দি গ্রামের কামালের। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে কামাল দ্বিতীয়। বাবা কৃষি কাজ করেন। সাড়ে তিন বছর ইরাকে থাকার পর ইউরোপে যাওয়ার একটা পথ পেয়ে যান তিনি। কাজের সন্ধানেই বাগদাদ থেকে ইরাকের কিরকুক শহরে যান কামালসহ কয়েকজন বাংলাদেশী। সেখানেই মূলত পরিচয় হয় এক বাঙালি দালালের সাথে। সেই দালালই স্বপ্ন দেখায় ইউরোপযাত্রার। ইরাক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইরান হয়ে তাদের ঢোকানো হবে তুরস্ক। সেখান থেকে ইউরোপের দেশ গ্রিস বা অন্য কোনো দেশে। ইউরোপের স্বপ্নে বিভোর কামালসহ তার সঙ্গীরা রাজি হয়ে যান।

প্রায় দেড় মাস কিরকুক শহরে থাকার পর বাঙালি দালাল ও ইরাকি দালালের মাধ্যমে কামালসহ দুইজন বাংলাদেশী শ্রমিক কিরকুক শহর থেকে ইরান বর্ডারের উদ্দেশে রওনা দেন। সোলেমানিয়া বর্ডারে ভোর হয়ে যায়। কামাল জানান, পাহাড়ি এলাকা, বিশাল জঙ্গল। রাতে অনেক শীত। শীত নিবারণে আগুন জ্বালানো হলো। ইরাকি দালাল দূরবীণ দিয়ে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর টহল দেখে নিলেন। সেখান থেকে হাঁটা শুরু হলো। পথে গিয়ে আরো এক বাংলাদেশীকে পেলাম। ইরাকি দালাল আমাদের ইরানের দালালের হাতে ছেড়ে দিলেন। সীমানা পার হয়ে ইরানের কুর্দিস্থানে পৌঁছলাম। ইরানের উমিয়া শহরে রাত কাটালাম একটা রুমে। সেখানে গিয়ে মাদারীপুরের দুইজন এবং চাঁদপুর ও বিক্রমপুরের আরো দুইজনকে পেলাম। তাদের একজন দুুবাই থেকে ইরানে, আরেকজন ইরানের টুরিস্ট ভিসায় ঢুকেছেন। আরেকজন কাতার হয়ে সাগরপথে ইরানে ঢুকেছেন। এর কয়েক দিন পরেই ছিল কোরবানির ঈদ। সিদ্ধান্ত হলো, উমিয়া শহরে এই কয়েকদিন থাকার পর ঈদের পরদিন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তুরস্কে ঢুকানো হবে তাদের। এই কয়েক দিনে সিলেটি আরো চারজন আমাদের সঙ্গী হলেন। তারা ওমান থেকে ইরানে ঢুকেছেন। সবমিলে আমরা আটজন হলাম। একটা বড় টেক্সিতে সেখান থেকে সীমান্ত এলাকা মাক্কু বর্ডারে (ইরান) উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হলো। রাস্তায় গাড়ি পরিবর্তন করা হলো। ওই বর্ডারে এক রাত রাখা হলো আমাদের। রাতে বলা হলো, সবাই যেন নিজেদের ব্যাগ গুছিয়ে রাখি। সেখানে আমরা আরো শতাধিক মানুষকে পেলাম। ১২০-১৩০ জনের মতো হবে।

এদের মধ্যে ৩০-৩৫ জনের মতো বাংলাদেশী। বাকিরা সিরিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের। সেখানে পুরুষের পাশাপাশি নারীও ছিলেন। বিভিন্ন দেশ বা পথ দিয়ে তারা ইরান সীমান্তে গিয়েছেন। পাহাড়ি এলাকা। সবাইকে নিয়ে রাতে হাঁটা শুরু হলো। প্রায় তিন ঘণ্টা হাঁটার পর ইরানি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তুরস্ক সীমানার ভেতর সেফজোনে আমাদের নেয়া হলো। সেখান দুইজন তুর্কি ঘোড়া নিয়ে আমাদের দেখে গেলেন। বললেন, ঘোড়ার গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে যাবেন। যারা ওখানে গিয়েছি, কে কোন দালালের মাধ্যমে গিয়েছি তা জিজ্ঞেস করলেন ওই ঘোড়সওয়ারি। কিন্তু এরই মধ্যে সমস্যা হয়ে গেলো। আমাদের যেখানে রাখা হয়েছিল তা কয়েকজন ভেড়ার রাখাল দেখে ফেললেন। তারা ওই এলাকার সেনাবাহিনীকে খবর দেন। তুরস্কের সীমান্তবর্তী এলাকা টহলরত সেনাবাহিনী আমাদের ঘিরে ফেলল। ফাঁকা গুলিও করতে থাকল। সবাই কান্না শুরু করলাম। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লাইন করে দাঁড় করালো আমাদের। কোন দেশের কয়জন রয়েছি তা জেনে নিলেন তারা। এরপর স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আমাদের ছবি তুললেন।

আমাদের মধ্যে পাকিস্তানি কয়েকজন ছিলেন, যাদের তুরস্কে পরিবার ছিল। তারা তাদের সাথে যোগাযোগ করল। তাদেরসহ কয়েকজন আফ্রিকানকে তুরস্কে রেখে দিয়ে আমাদের ইরানে পাঠিয়ে দিলো। যেসব দালাল আমাদের পাচার করেছে ইরানি সেনাবাহিনী তাদের কয়েকজনকে ধরে আমাদের সামনেই পেটাতে থাকল। এরপর আমাদের নিজ নিজ দেশে পাঠানোর কথা বলে তারা ইরানের দালালের হাতে তুলে দিলো। কিন্তু দালালেরা ফের আমাদের ইরানের মাফিয়াদের হাতে তুলে দিলো। কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে পরের দিন আমাদের ফের তুরস্কে ঢুকালো। এটা এক জনবসতিহীন এলাকা। ঝর্ণা-পাহাড়। তুর্কির ভ্যান শহর। সীমান্ত থেকে প্রায় ২ ঘণ্টার পথ। সেখানে কয়েক দিন থাকার পর আমাদের এক এক করে তুর্কিরা নিয়ে যায়। ইরাক থেকে তুরস্ক যাত্রার পথে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করে কামাল বলেন, ইরাক থেকে ইরানে পৌঁছতে দালালকে ৫০ হাজার টাকা এবং ইরান থেকে তুরস্কে ঢুকতে আরো ৫০ হাজার মোট এক লাখ টাকা দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, ভ্যান শহর থেকে তাদের ইস্তাম্বুলে নেয়া হয়। সেখানেই একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করছেন বর্তমানে। সেখানে বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের অভিবাসীরা রয়েছেন। যাদের বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই।

কামাল বলেন, তবে ভালো কাজ, ভালো বেতন পেতে হলে কাগজপত্র লাগে। সেখানে তার মতো অনেক বাংলাদেশী রয়েছেন এভাবে। তাদের বেশির ভাগেরই লক্ষ্য ইউরোপে ঢোকা। কামাল বলেন, ইউরোপে ঢোকার জন্যই তো এসেছি এখানে। সীমান্ত দিয়ে একটা খাল পাড়ি দিলেই গ্রিস। করোনাকালে গ্রিস সীমান্তে খুব কড়াকড়ি। তাই ‘গেইম’ (দালালের মাধ্যমে সীমান্ত পাড়ি দেয়াকে গেইম বলে) দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। একটা গেইম দিতে দুই লাখ টাকা দিতে হয় দালালকে। এ ছাড়া মালবাহী লড়ির ভেতর ঢুকিয়েও তুরস্ক থেকে গ্রিসে পাঠিয়ে থাকে দালালরা। গ্রিস থেকে রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া; এরপর ফ্রান্স, ইতালি বা ইউরোপের অন্যান্য দেশে গিয়ে অভিবাসী হন। কামালের এ ধরনের বেশ কয়েকজন বন্ধু রয়েছেন, যারা এক সাথে ইরাকে কাজ করেছেন। কিংবা পূর্ব পরিচিত। ফ্রান্সে আছেন আফাজ আলী, সোহেল, মাহী ও রুবেল। তাদের সাথে বাগদাদে কাজ করেছেন কামাল। ৮-৯ মাস আগে তারা ইরান, তুর্কি হয়ে ‘গেইম দিয়ে’ ফ্রান্স পাড়ি দিয়েছেন বলে জানান তিনি। এ ছাড়া আকাশ ও রোমান তুর্কি হয়ে জার্মানি হয়ে বর্তমানে ফ্রান্সে আছেন। তাদের সবার বয়স কামালের মতোই অর্থাৎ ২০-২২ বছর। আকাশ, সোহেল, শাহীন বিক্রমপুরেরই ছেলে। তবে কামাল মাহমুদের বক্তব্য- গেইম দেয়ার ক্ষেত্রে সিলেটিরাই এগিয়ে। কারণ তাদের লাইন ভালো। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাদের ভালো ভালো লোক রয়েছে।

আব্দুল আলিম : বাড়ি জামালপুরের ইসলামপুরে। ৯ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় বাবা মারা যান। লেখাপড়া বাদ, হাল ধরেন সংসারের। ২০০৭ সালে তিনি দুবাইতে পাড়ি জমান। তিন বছর থেকে ২০১০ সালে দেশে ফেরেন। ২০১৪ সালে ফের প্রবাসজীবন বেছে নেন আলিম। যান ইরাকের বাগদাদে। সেখানে থাকা অবস্থায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কামাল মাহমুদের মতোই একইভাবে দালালের মাধ্যমে ইরান-তুরস্ক হয়ে যান ইউরোপের দেশ গ্রিসে। তবে ভাগ্য তার সহায় হয়নি। গ্রিস সীমানায় প্রবেশের পরই ধরা পড়েন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। সেখানে জেল খাটার পর ফের তুরস্ক-ইরান হয়ে ইরাকে ফিরতে হয় তাকে। বর্তমানে তিনি ইরাকের বাগদাদে একটি দোকানে কাজ করছেন।

কামাল ও আব্দুল আলিমের মতো একইভাবে দালালের মাধ্যম যারা ইউরোপে গিয়েছেন তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। তবে অভিবাসনের ক্ষেত্রে ক্ষতি হতে পারে এমন আশঙ্কায় তারা রাজি হননি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কোনো কোনো ইরাক প্রবাসী ইউরোপযাত্রায় আগ্রহী করতে প্রচারণা চালাচ্ছেন। তারাও এই অবৈধ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছেন বলে জানা গেছে।


আরো সংবাদ



premium cement