২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধে নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ চাইল ঢাকা

- ছবি : সংগৃহীত

নিরাপত্তা অভিযানের নামে রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের চলমান নিপীড়ন বন্ধ করতে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ চেয়েছে বাংলাদেশ।

মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নিপীড়নের মুখে রাখাইনে অবস্থানরত বাদবাকি রোহিঙ্গাও আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্ত পাড়ি দিতে পারে বলে বাংলাদেশ আশঙ্কা করছে। পরিকল্পিতভাবে নৃশংসতা চালানোর কারণে দফায় দফায় প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞের মুখে সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছে।

নিউ ইয়র্কের স্থায়ী মিশন থেকে সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্টের কাছে দেয়া এক চিঠিতে রাখাইনের চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এতে যেকোনো নিরাপত্তা অভিযানের সময় বেসামরিক মানুষের সুরক্ষা দেয়ার জন্য মিয়ানমারের দায়-দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। চিঠিতে রাখাইনের পরিস্থিতিকে আরো উত্তেজনাকর করা থেকে মিয়ানমারকে বিরত রাখতে নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে।

রাখাইনে অস্বাভাবিক হারে সৈন্য সমাবেশ এবং বাংলাদেশ সীমান্তে সন্দেহজনক গতিবিধির কারণ জানতে গত ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পরবর্তী সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মিয়ানমার জানিয়েছে, রাখাইনে পুরনো সৈন্যদের সরিয়ে নতুন সৈন্য মোতায়েন করা হচ্ছে। এ কারণে সাময়িকভাবে সৈন্য সমাবেশ বেড়ে গেছে। তবে সৈন্যদের এই মুভমেন্টের জন্য বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কোনো কারণ নেই। নাফ নদীতে বেসামরিক নৌযানে সৈন্যদের চলাচল বা রাখাইনে পরিচালিত অভিযানে আর্টিলারি, হেলিকপ্টার বা যুদ্ধবিমানের ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশের প্রশ্নের সন্তোষজনক কোনো জবাব দেয়নি মিয়ানমার।

রাখাইনের স্বায়ত্তশাসনের জন্য সঙ্ঘাতে লিপ্ত আরাকান আর্মির পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় লড়াইরত আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মিকে (আরসা) দমন করতে ক্লিয়ারেন্স অপারেশন চলছে বলে মিয়ানমার দাবি করছে। রাখাইনে বিপুলসংখ্যক সৈন্যের পাশাপাশি ভারী যুদ্ধাস্ত্রের সমাবেশ বাংলাদেশকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ২০১৭ সালের আগস্টে আরসার বিরুদ্ধে ক্লিয়ারেন্স অপারেশন চালানোর আগে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী একই ধরনের তৎপরতা চালিয়েছিল।

সম্প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দু’জন সৈন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা চালানোর দায় নিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাখাইনে পুরনো সৈন্যদের সরিয়ে নতুন সৈন্য মোতায়েন করা হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এর আগে চীন ও রাশিয়া ছাড়া নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলো রাখাইন সঙ্কট নিরসনে কফি আনান কমিশন (রাখাইন পরামর্শক কমিশন) এবং স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে মিয়ানমারের কাছে বিশ্বাসযোগ্য পরিকল্পনা চেয়েছিল।

একইসাথে তারা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপগুলো অনুসরণে মিয়ানমারের বাধ্যবাধকতা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল। গত ১২ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার পরিস্থিতির ওপর আয়োজিত এক ব্রিফিং শেষে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর দেয়া যৌথ বিবৃতিতে এই অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।

পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স এবং অস্থায়ী সদস্য জার্মানি, বেলজিয়াম, ডোমিনিকান রিপাবলিক, এস্তোনিয়া, তিউনিসিয়া ও নর্দন আয়ারল্যান্ড যৌথভাবে এই বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা, নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদার সাথে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় সংলাপ জোরদার করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়, রাখাইনে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও মৌলিক সেবাগুলো নিশ্চিত করতে হবে। তাদের চলাচলের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নিতে হবে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের (আইডিপি) ক্যাম্পগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। মিয়ানমারের দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় এবং শরণার্থী ও আইডিপি ক্যাম্পগুলোতে থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরাতে জবাবদিহিতা একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের সাথে জড়িতদের দায়মুক্তির অবসান ঘটাতে হবে এবং তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। মিয়ানমারকে স্বাধীন তদন্ত পদ্ধতিসহ সব আন্তর্জাতিক বিচার কাঠামোর সাথে সহযোগিতা করতে হবে।

গত ২৩ জানুয়ারি রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা-নির্যাতন বন্ধ, তাদের বাস্তুচ্যুতিরোধ এবং গণহত্যার অভিযোগ সংশ্লিষ্ট আলামতগুলো সংরক্ষণ করার জন্য মিয়ানমারের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিল আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলায় আইসিজে এই অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেয়। ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সমর্থনে গাম্বিয়া জাতিসঙ্ঘের গণহত্যার সনদ ভঙ্গের অভিযোগে গত ১১ নভেম্বর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজেতে মামলা করে। গাম্বিয়ার অভিযোগ, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে, যার প্রক্রিয়া আজো অব্যাহত রয়েছে।

অভিযোগের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আইসিজের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ বাস্তবায়নে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা মিয়ানমারকে ছয় মাস অন্তর প্রতিবেদন দিয়ে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একইসাথে গাম্বিয়াকে এ সব প্রতিবেদন সরবরাহ করতে হবে যাতে দেশটি তাদের মতামত দিতে পারে। মিয়ানমার ও গাম্বিয়া এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন ও মতামত আইসিজেকে দিয়েছে। তবে আদালত তা প্রকাশ করেনি।

এ দিকে রাখাইনে গণহত্যার মতো যুদ্ধাপরাধ আবারো সংঘটিত হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচিলেট। গত ১৪ সেপ্টেম্বর জেনেভায় জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৪৫তম অধিবেশনে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান এবং নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে তাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার ব্যাপারে মিয়ানমার বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু উপগ্রহ চিত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে জানা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতেও মিয়ানমার উত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলো নিশ্চিহ্ন করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক।


আরো সংবাদ



premium cement