২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

যেভাবে বাংলাদেশি অভিবাসীদের গন্তব্য হয়ে উঠলো লিবিয়া

যেভাবে বাংলাদেশি অভিবাসীদের গন্তব্য হয়ে উঠলো লিবিয়া
যেভাবে বাংলাদেশি অভিবাসীদের গন্তব্য হয়ে উঠলো লিবিয়া - ছবি : সংগৃহীত

লিবিয়ায় মিজদা শহরে অপহরণকারীরা ২৬ জন বাংলাদেশিসহ ৩০ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ত্রিপোলিতে শ্রম বিষয়ক কাউন্সিলর আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, মানব পাচারকারীদের কাছ থেকে একদল বাংলাদেশি ও সুদানি নাগরিক অপহৃত হওয়ার পর তাদের হাতে একজন অপহরণকারী খুন হন। এর প্রতিশোধ নিতেই বৃহস্পতিবার অপহরণকারীরা গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করে।

এই ঘটনায় ১১ জন বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। লিবিয়া হয়ে এরা সবাই ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশিরা মানব পাচারকারীদের সহায়তায় নানা দেশ ঘুরে লিবিয়া পৌঁছাচ্ছে, এবং সেখান থেকে নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সমুদ্রে নৌকা ডুবে বহুসংখ্যক বাংলাদেশির মৃত্যু হলেও ঝুঁকিপূর্ণ এ প্রবণতা বন্ধ হয়নি।

বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্য লিবিয়া কেন ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে উঠলো - তা জানতে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর প্রধান তাসনিম সিদ্দিকীর সাথে।

তাসনিম সিদ্দিকী বলছিলেন, শুধু বাংলাদেশিদের কাছে নয়, এশিয়া ও আফ্রিকার আরো বহু দেশের অবৈধ অভিবাসীদের জন্য কীভাবে ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে উঠলো লিবিয়া।

২০০০ সালের দিকে ইংল্যান্ডে অবৈধ অভিবাসীদের ধরপাকড় শুরু হলে তাদের অনেকেই স্পেন এবং ইতালি চলে যান।

অন্যদিকে, লিবিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার পর ২০০৮ সালের দিকে প্রচুর বাংলাদেশি লিবিয়ায় কাজের জন্য যেতে শুরু করেন বলে তাসনিম সিদ্দিকী জানান ।

তখনই ইতালিতে থাকা বাংলাদেশিরা তাদের আত্মীয়স্বজনদের সেখানে নিযে যেতে, অথবা টাকার বিনিময়ে ইউরোপে লোকজন নিয়ে যাবার জন্য কাজ করতে শুরু করেন। এ সময়ই তারা লিবিয়াকে একটা রুট হিসেবে বেছে নেন।

মানব পাচারের রুট
এরা সুদান এবং আফ্রিকার নানা দেশ হয়ে প্রথমে লিবিয়ায় যান। তারপর লিবিয়া থেকে ডিঙি নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি বা অন্য কোন ইউরোপীয় দেশে যেতে থাকেন।

প্রথমে এটা হয়তো ইতালিতে থাকা বাংলাদেশিদের আত্মীয়স্বজনকে ইউরোপে নিয়ে যাবার জন্য ব্যবহৃত হতো। কিন্তু পরে এই রুটে মানবপাচারের সংগঠিত চক্র আত্মপ্রকাশ করে। এই চক্রগুলোর সাথে সুদান, মিশর, এবং লিবিয়াসহ নানা দেশের লোক জড়িত।

প্রতিটি জায়গাতেই পাচারকারীদের এক চক্রের হাত থেকে অবৈধ অভিবাসীদের দলগুলোকে আরেক চক্রের হাতে তুলে দেয়া হয়। এ মুহূর্তে বাংলাদেশিদের সবগুলো রুটই গেছে আফ্রিকার নানা দেশের মধ্যে দিয়ে।

দেশের কিছু অসাধু জনশক্তি রিক্রটিং এজেন্সি আছে যারা সুদানে লোক পাঠাচ্ছে। সুদানে তো গৃহযুদ্ধ চলছে, এখানে তো কাজ নেই। তার পরও সেখানে লোক যাচ্ছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে - এর আড়ালে একটা কিছু হচ্ছে।

ওই সুদান পর্যন্ত একটা বৈধ ট্রাভেল ডকুমেন্ট দিয়ে লোক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সুদান থেকে তারা যাচ্ছে লিবিয়ার বেনগাজি। সুদান থেকে তারা ট্রাকে করে সীমান্ত পার হয়ে লিবিয়া ঢুকছেন। এ সীমান্ত পার হতে গিয়ে অনেকে মারাও গেছেন।

পথে নানান জায়গায় তাদের দীর্ঘ সময় থাকতে হয় – এক মাস দু’মাস পর্যন্ত।

‘‘আমার কাছে এমন তথ্যও আছে যে কারো কারো পাঁচ বছর লেগে গেছে ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছাতে। এরা ইউরোপে ঢোকেন প্রধানত ইতালি দিয়ে। তারপর অনেকে যুক্তরাজ্য সহ ইউরোপের নানা দেশে চলে যান – এমনও হয়।’’

তাসনিম সিদ্দিকী জানান, ২০০০ সালের দিকে যখন স্পেন ও ইতালিতে কৃষিক্ষেত্রে কাজের সুযোগ তৈরি হলো, তখন তারা নিয়মিত শ্রমিক না নিয়ে অবৈধ অভিবাসীদের এসব কাজে লাগিয়েছে। পরবর্তীকালে এসব অভিবাসীদের তারা বৈধ করে নিয়েছে।

ফলে কিছু বাংলাদেশির মনে ধারণা তৈরি হয়েছে যে কষ্ট করে একবার ইতালি যেতে পারলে কিছুদিন পরই আমরা রেগুলারাইজড হয়ে যাবো। এভাবেই অবৈধ অভিবাসনের ক্ষেত্রটা তৈরি হয়েছে।

কিন্তু লিবিয়া মানবপাচারকারীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠলো কেন?
তাসনিম সিদ্দিকী বলছিলেন, লিবিয়ায় এখন রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী দেশটির নানা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। আর মানবপাচারকারী চক্রগুলো অভিবাসীদের বিভিন্ন জায়গায় আটকে রেখে নির্যাতন করছে।

“আমি এরকম অনেককে ইন্টারভিউ করেছি। যখন তাদের জিজ্ঞেস করেছি যে জেনে শুনে এরকম পথে আপনি কেন যাবেন? তখন সে জবাব দিয়েছে, আমার বেলায় এরকম কিছু হবে না। আমি বিদেশে গিয়ে আমার পরিবারের জীবন পাল্টে ফেলতে পারবো।”

লিবিয়ার এসব মানব পাচারকারী চক্রের হাত বাংলাদেশ পর্যন্তও পৌঁছে গেছে।

যেসব রিক্রটিং এজেন্সি লোকজনকে সুদান নিয়ে যাচ্ছেন, তারা কি জানেন না যে সুদানের পর এসব লোকেরা কিভাবে কোথায় যাবে? বহু এজেন্সি আছেন যারা এ চক্রের সাথে জড়িত।

বাংলাদেশে এসব মানবপাচার চক্রকে ধরার জন্য কতটা কাজ হচ্ছে?
প্রথম কথা, বিদেশে জনশক্তি পাঠানোর আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার বাইরে এ ঘটনাটা ঘটছে। এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সিভিল এভিয়েশন – এসবের কিছু অসাধু ব্যক্তির সাথে যোগসাজশে এটা চলছে। তারা বুঝে বা না-বুঝে, চোখ বন্ধ করে থেকে এই মানুষগুলোকে যেতে দিচ্ছেন।

তাই এটা যদি থামাতে হয়, তাহলে সবার আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দায়বদ্ধ হতে হবে। তাদের বুঝতে হবে যে এ মানুষগুলো ক্রমাগত লাশে পরিণত হচ্ছে।

আমি দাবি করছি. ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন যেন সেখানকার ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে যে শত শত বাংলাদেশি আছে তাদের ফেরত পাঠায়, এবং ইউরোপকে ‌‘দুর্গ‌’ বানানোর নীতি ত্যাগ করে যেন তারা বৈধ অভিবাসনের সুযোগ আবার উন্মুক্ত করেন। বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement