২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
২৬ বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা

ইউরোপে মানব পাচারের সবচেয়ে বড় রুট এখন লিবিয়া

২৬ বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা - সংগৃহীত

ইউরোপে মানব পাচারের সবচেয়ে বড় রুট এখন ভূমধ্যসাগর তীরের দেশ লিবিয়া। ইউরোপে মানব পাচারকারীদের স্বর্গরাজ্য হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে যুদ্ধ বিধ্বস্ত এ দেশটি। উন্নত জীবনের আশা জাগিয়ে মানব পাচারকারী চক্র বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষিত বেকার যুবকদের লিবিয়ায় নিয়ে থাকে। এরপর তাদের পণবন্দী করে পরিবারের কাছ থেকে ৭-৮ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করার পর ইতালি বা ইউরোপের কোনো দেশে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে নৌকা বা ট্রলারে তুলে দেয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব অভিবাসীর সলিল সমাধি হয় সাগরে। আবার অনেকের জীবন যায় মানব পাচারকারীদের নির্যাতন-নির্মমতায়। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার লিবিয়ার মিজদাহ শহরে মানবপাচারকারীদের গুলিতে ২৬ জন বাংলাদেশী ও ৪ জন আফ্রিকান নাগরিকের মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় আহত হন আরো কমপক্ষে ১২ জন।

জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে বিশ লাখ মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছেন। এভাবে সাগরপথ পাড়ি দিতে গিয়ে ১৯ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। যার মধ্যে অনেক বাংলাদেশীও রয়েছেন। ভূমধ্যসাগর দিয়ে যত মানুষ ইউরোপে প্রবেশ করার চেষ্টা করে, সেই তালিকার শীর্ষ দশে আছে বাংলাদেশের নাম। এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলেই শুধু ৬৯৩ জন বাংলাদেশী এভাবে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে আটক হয়েছেন। আফগানিস্তান, সিরিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো, মালি, আইভরি কোস্ট, ইরাক, গায়েনা ও সুদানের মতো দেশের সাথে বাংলাদেশীদের এভাবে ইউরোপ যাত্রা দেশের ভাবমূর্তিকেও সঙ্কটে ফেলে বলে মনে করেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান।

লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় জড়িত মানবপাচারকারী চক্রকে দ্রুত গ্রেফতার ও শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে প্রয়োজনে বাংলোদেশকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নিতে হবে। কারণ লিবিয়ার এই পাচারকারী চক্র ইউরোপে পাঠানোর নামে দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসীদের পণবন্দী ও নিপীড়ন করছে। এরই সর্বশেষ শিকার বাংলাদেশীরা।

শরিফুল হাসান বলেন, লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলছে। এটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু এই সুযোগ নিয়ে প্রায় এক দশক ধরে মানবপাচারকারী চক্র সেখানে সক্রিয়। তারা ইউরোপে লোক পাঠানোর নামে এককজনের কাছ থেকে গড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা নিচ্ছে। ভূমধ্যসাগরের কাছে লিবিয়ার বিভিন্ন সীমান্তে ক্যাম্প করে তারা লোকজনকে পণবন্দী করে ছোট ছোট নৌকায় করে ইউরোপে লোক পাঠাচ্ছে।

ব্র্যাক অভিবাসন প্রধান বলেন, বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় কর্মী পাঠানো গত পাঁচ বছর ধরেই বন্ধ। তারপরেও কী করে এতো লোক বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া যাচ্ছে সেই ঘটনার তদন্ত করা উচিত। শরিফুল হাসান জানান, গত কয়েক বছরে আইওএম ও ব্র্যাকের প্রত্যাশা প্রকল্প থেকে সাড়ে তিন শ’ লিবিয়াফেরত বাংলাদশীকে সহায়তা দেয়া হয়েছে। ফিরে আসা বাংলাদেশীরা পণবন্দী ও মুক্তিপণ আদায়সহ নিপীড়নের নানা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদন ও গণমাধ্যমেও এসব কথা উঠে এসেছে। এভাবে যেন আর কোনো অভিবাসী সেখানে প্রাণ না হারায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে জোর ভূমিকা পালন করতে হবে।

জানা যায়, লিবিয়ায় মাঝে মধ্যেই বাংলাদেশীদের পণবন্দী করে নির্যাতন ও অর্থ আদায়ের ঘটনা ঘটে। প্রায়ই সেখানে দুর্ঘটনায় বাংলাদেশীরা প্রাণ হারাচ্ছেন। সর্বশেষ ২৬ জন নিহতের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজন বাংলাদেশী ঘটনার যে বিবরণ দিয়েছেন তা লিবিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। হত্যার শিকার থেকে বেঁচে আসা ওই বাংলাদেশী জানিয়েছেন, তিনিসহ ৩৮ জন বাংলাদেশী ও আরো কয়েকজন আফ্রিকান নাগরিককে জিস্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য জড়ো করেছিল মানবপাচারকারী চক্র। লিবিয়ার বেন গাজী থেকে ত্রিপলীতে কাজের জন্য নিয়ে আসার সময় দেশটির মিজদাহ শহরে তাদের জিম্মি করে নির্যাতনের একপর্যায়ে মূল অপহরণকারী লিবিয়ান নাগরিক নিহত হন। এরপর পাচারকারী চক্রের অন্য সদস্যরা তাদেও গুলি করে হত্যা করে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ওই ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া এক বাংলাদেশী দূতাবাসকে তথ্য দিচ্ছেন। তার তথ্য মতে, যতটুকু জানতে পেরেছি সেটা হলো আমাদের বাংলাদেশীরা পাচারকারীদের প্ররোচনায় পড়ে সেখানে গেছেন। ইউরোপে যাওয়ার লোভে প্রায় ১০-১২ হাজার ডলার (বাংলাদেশী টাকায় ৮-১০ লাখ টাকার বেশি) করে প্রত্যেকে দিয়েছেন। তাদের সাথে কয়েকজন আফ্রিকানও ছিলেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, একপর্যায়ে পাচারকারীরা আরো টাকা চাচ্ছিল। এটা নিয়ে তাদের মধ্যে বচসা হয়। তখন চার আফ্রিকানের মধ্যে একজন ওই পাচারকারীদের নেতাকে মেরে ফেলে। তার প্রতিশোধ নিতে নিহত পাচারকারীর পরিবার এবং বাকি পাচারকারীরা এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়ে। এতে এক রুমের মধ্যে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে ৩০ জন মারা যায়, যাদের ২৬ জনই বাংলাদেশী। এছাড়া ১১ জন বাংলাদেশী আহত হন। আর একজন বাংলাদেশী অক্ষত ছিলেন। তিনি পালিয়ে একটি ফার্মেসিতে আশ্রয় নেন। পাচারকারীরা ওই ফার্মেসিও ভেঙে ফেলে। তবে ওই বাংলাদেশী সেখান থেকে একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে ভয়ে তার অবস্থান জানাচ্ছেন না।
তিনি জানান, এসব বাংলাদেশী দেশের কোন কোন জেলা থেকে গেছেন তা এখনো জানা যায়নি। তবে আমাদের দূতাবাস কর্মকর্তারা জীবিত উদ্ধার হওয়ার ব্যক্তিদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানার চেষ্টা করছেন। তথ্য পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।

ড. মোমেন বলেন, লিবিয়ায় আমাদের মিশন তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে। এছাড়া ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি আহতদের নিরাপত্তা দেয়ার কথাও বলেছি আমরা।

তিনি জানান, যে এলাকায় এটা ঘটেছে গত সপ্তাহে ত্রিপলী সরকার সে এলাকার কর্তৃত্ব নিয়েছে। তবে বোমা দিয়ে পুলিশের সব অফিস ভেঙে ফেলেছে। মিলিশিয়ারাও পালিয়েছে। সত্যিকার অর্থে সেখানে কোনো সরকার নেই।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মূলত বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকার লোকজন এভাবে ইউরোপে যায়। এই এলাকাগুলো ঘিরেই শক্তিশালী দালাল চক্র গড়ে উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে। স্থানীয় দালাল চক্রের পাশাপাশি লিবিয়া বা অন্য দেশে আন্তর্জাতিক মানব-পাচারকারী চক্রগুলো যোগসাজশ করে বাংলাদেশ থেকে লোভনীয় অফার দিয়ে ইউরোপ যাত্রায় শিক্ষিত যুবকদের লিবিয়া বা ভূমধ্যসাগর তীরের আশেপাশের দেশে নিয়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সেখানে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে বড় মাপের মুক্তিপণ আদায় করে। তাদের উপর অমানসিক নির্যাতন চালায়। অনেকে মানপাচারকারীদের নির্যাতনেই মারা যান, বেঁচে থাকাদের ইতালি বা ইউরোপের কোনো দেশে পাঠানোর কথা বলে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে নৌকায় তুলে দেয়া হয়। যাদের অনেকেরই সলিল সমাধি ঘটে সাগওে, যা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়।

গত বছরের ৯ মে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরের নৌকা ডুবিতে প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ জন নিখোঁজ হন। এদের মধ্যে বাংলাদেশী ছিলেন ৩৯ জন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভিকটিমের স্বজনরা শরীয়তপুরের নড়িয়া ও সিলেটের বিশ্বনাথ থানায় দুটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলার সূত্র ধরেই তদন্তে নাম র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটিলিয়ান (র‌্যাব)। র‌্যাব ওই বছরের ১৬ মে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে দু’টি পাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকে আটক করে।
র‌্যাব জানায়, ইউরোপে মানবপাচারের সাথে দেশজুড়ে অন্তত ১০ থেকে ১৫টি চক্রের তথ্য পাওয়া গেছে।

দেশজুড়ে এই চক্রের সদস্যরা ইউরোপে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রথমে লোক সংগ্রহ করে। তারপর সেসব লোকদের সড়ক-বিমানপথ মিলিয়ে তিনটি রুটে লিবিয়ায় পাঠায়। সর্বশেষ লিবিয়া থেকে নৌপথে তিউনিসিয়ার উপকূল হয়ে ইউরোপে পাঠায়। ৭ থকে ৮ লাখ টাকার অর্থের বিনিময়ে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগে দুই মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত। ভিকটিমদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকিট ক্রয় সবই এই সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয় বলে জানতে পারে র‌্যাব।

ইউরোপে পাচারে চক্রটি তিনটি রুট ব্যবহার করে থাকে। রুটগুলো হলো বাংলাদেশ-ইস্তাম্বুল-লিবিয়া, বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলঙ্কা (৪-৫ দিন অবস্থান)-ইস্তাম্বুল (ট্রানজিট)-লিবিয়া এবং বাংলাদেশ-দুবাই (৭-৮ দিন অবস্থান)-আম্মান (জর্ডান) (ট্রানজিট)-বেনগাজী (লিবিয়া)-ত্রিপলী (লিবিয়া)।
এক্ষেত্রে তারা সড়ক ও বিমানপথ ব্যবহার করে লিবিয়া পৌঁছিয়ে থাকে। সর্বশেষ লিবিয়া থেকে নৌপথে তিউনিসিয়ার উপকূল হয়ে ইউরোপে পাচার করে থাকে চক্রটি।


আরো সংবাদ



premium cement