২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলাপ্রেমী বিদেশিরা

- ছবি : সংগৃহীত

বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা আছে অনেক বিদেশির। তাদের কেউ কেউ ভাষার টানেই স্থায়ী হয়েছেন বাংলাদেশে। ভালোবেসে ফেলেছেন এখানকার সংস্কৃতি আর জল-হাওয়া। বাংলার জন্য আছে তাদের গভীর ভাবনাও।

‘‘কষ্ট পাই এই দেশের বাংলাভাষীরা যখন বাংলা বলতে গিয়ে তার মধ্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন। অনেকে রেগে গেলেও ইংরেজি বলেন। তারা মনে করেন ইংরেজি বললে গুরুত্ব বাড়ে। আমার কষ্ট হয়, যে দেশের মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখে।’’

কথাগুলো কোন বাংলাদেশি নন, বললেন একজন বিদেশি। নিজেও তিনি পরিস্কার বাংলাতেই কথা বলেন। আলাদা করে বোঝার উপায় নেই যে তিনি ইটালির নাগরিক। বোঝা যাবেই বা কী করে! এই দেশের ভাষা, সংস্কৃতিকে যে তিনি নিজের প্রাণেই ধারণ করেছেন! বলছি লুসিও বেনানিতির কথা। তার বয়স এখন ৬৪ বছর।

কুড়ি বছর আগে এসেছেন বাংলাদেশে। এরপর থেকে ঢাকার বস্তি আর পথশিশুদের নিয়েই আছেন। তাদের শিক্ষা, খেলাধুলা, খাবারের ব্যবস্থা করেন নিজস্ব উদ্যোগে।

তিনি ভাষাকে দেখেন ভালোবাসার একটি মাধ্যম হিসেবে। ভালোবেসে ফেলেছেন বাংলাকেও। তাই প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করেন না। বাংলাতেই কথা বলেন, লিখেন। এমনকি গাইতেও পারেন।

তিনি বলেন, ‘‘গান আছে তো ‘আমি কি ভুলিতে পারি’। এই গানে যা বলা হয়েছে তা-ই করতে হবে। দেশকে ভালোবাসতে হবে।’’

কিভাবে শিখলেন বাংলা ভাষা? তার জবাব, ‘‘এটা আমি নিজেই চর্চা করে শিখেছি। কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে নয়। শুরুতে এখানকার বন্ধুদের সহায়তা নিয়ে বর্ণমালা শিখেছি। তারপর আমি চর্চা করেছি। এটা আমাকে শিখতে হয়েছে। কারণ, যাদের আমি ভালোবাসি, তাদের ভাষা বাংলা। এই ভাষা না জানলে আমি ভালোবাসা প্রকাশ করবো কিভাবে?’’

তার মতে স্কুলে গিয়ে ভাষা শেখা যায়, কিন্তু চর্চাই প্রধান। তারপরও বাংলা সম্পর্কে তার কৌতুহল আর জানার আগ্রহের শেষ নেই। ‘‘আমি বইপত্র পড়ি। চর্চা করি। তারপরও আমি বলতে পারি না যে, আমি বাংলা ভাষা পুরোপুরি শিখতে পেরেছি,’’ বললনে লুসিও।

লালন প্রেমে বাংলা প্রেম
লালনের গান ভালোবেসে ২০১৬ সালে এই দেশে এসেছেন ফ্রান্সের দেবোরা এলিয়েট। নিয়েছেন নতুন নাম, দেবোরা জান্নাত। বিয়ে করেছেন বাংলাদেশেরই এক বাউল সাধককে। নাম ফকির রাজন শাহ। নিজেও হয়েছেন বাউল। কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়াতে থাকেন তিনি। সেখানেই কাটাতে চান বাকি জীবন।

লালনের গানের প্রতি তার ভালোবাসা জন্মায় ফ্রান্সে থাকতেই। সেখানে থেকেই তিনি বাংলা ভাষা শেখার চেষ্টা করেছেন। এই দেশে এসে রপ্ত করেছেন।

তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে বর্ণমালা মুখস্থ করি। আমার দেশে একজনের সহায়তা নেই। এখন বাংলাদেশে থেকে চর্চার মাধ্যমে শিখছি। লালন সাঁইর গানের ভাষা কিন্তু অত সহজ না। বাংলাদেশের অনেক মানুষও তা বুঝতে পারে না। আমি সেই ভাষাও এখন বুঝি। আর আমি কুষ্টিয়ায় থাকি, কারণ, এখানকার বাংলা শুদ্ধ বাংলা। লালনের গান বুঝতে হলে আমাকে তো বাংলা শিখতেই হবে।’’

বাংলাকে ‘মধুর ভাষা’ মনে করেন তিনি। তার মতে, এদেশের মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। ভাষা টিকিয়ে রাখতে এই লড়াইটা অব্যাহত রাখতে হবে। নয়তো বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলা কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে। তিনি বলেন, ‘‘ভাষা শিক্ষার মাধ্যম। এই দেশে গ্রামে ও শহরে শিক্ষায় পার্থক্য আছে। এটা দূর করতে হবে।’’

বিদেশিদের বাংলা শেখার আগ্রহ বাড়ছে
মানবতার সেবা, গবেষণা বা সাহিত্য বা এদেশের গানের প্রেমে পড়ে বাংলা ভাষা শিখছেন এমন আরো অনেক গল্প আছে। তাদের অধিকাংশই বাংলা শিখেছেন নিজস্ব উদ্যোগে। তবে এখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও বাংলা শেখার সুযোগ রয়েছে। এরকম একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ‘লার্ন বাংলা’। বেশ কয়েক বছর ধরে তারা বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখাচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, তারা চার মাসের ‘ফাউন্ডেশন কোর্স’ পরিচালনা করেন। আছে ‘অ্যাডভান্স কোর্সও’। চার মাসের কোর্স করলেই বিদেশিরা কাজ চালানোর মতো বাংলা বলতে ও লিখতে পারেন বলে জানান তিনি। তাদের প্রতিটি কোর্সে কমপক্ষে ৩০ জন বিদেশি বাংলা শেখেন।

লার্ন বাংলার তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৫০টি দেশের বিদেশিরা এই প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলা শিখেছেন। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার নাগরিকই বেশি। তবে আজকাল ভারতীয় নাগরিকরা বেশি আসছেন বাংলা শিখতে।

সেই কর্মকর্তা আরো জানান, ‘‘বিদেশিরা যারা এখানে বাংলার চর্চা করেন তারা বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথেও একাত্ম হয়ে যান। একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে যান। দল বেধে পহেলা বৈশাখে শাড়ি পরেন।’’ ডয়চে ভেলে।


আরো সংবাদ



premium cement