০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

সংস্কার অবশ্যই টেকসই হতে হবে : ভলকার তুর্ক

জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক - ছবি : সংগৃহীত

জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক আজ জোর দিয়ে বলেছেন, গত কয়েক দশকে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পিত সংস্কার অবশ্যই টেকসই হতে হবে।

তিনি বাংলাদেশে তার দুই দিনের সরকারি সফর শেষ করার পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘এবার অবশ্যই ন্যায়বিচার হতে হবে। এবার সংস্কার অবশ্যই টেকসই ও স্থায়ী হতে হবে, যাতে গত কয়েক দশকের নিবর্তনমূলক অনুশীলনের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’

তুর্ক মৌলিক পরিবর্তনের জন্য দেশের বর্তমান সুযোগের কথা তুলে ধরে বলেন, এ ধরনের পরিবর্তন মানবাধিকারের সমুন্নত রেখে শাসন, উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে একটি নতুন পথ নির্ধারণ করতে পারে।

তিনি বিভাজন, বৈষম্য ও দায়মুক্তি অবসানের লক্ষ্যে একটি দৃঢ় ভিত্তি স্থাপনের জন্য সাম্প্রতিক সামাজিক আন্দোলনের দ্বারা অনুপ্রাণিত উচ্চ প্রত্যাশাগুলোর উল্লেখ করে বলেন, ‘বৈষম্য, প্রতিশোধ ও প্রতিশোধের চক্র, প্রান্তিকতা, দুর্নীতি ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন অবশ্যই অতীতের বিষয় হওয়া উচিত।’

তিনি এসব নজিরগুলো ভাঙার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

হাইকমিশনার এই লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে তার দফতরের প্রতিশ্রুতিও নিশ্চিত করে উল্লেখ করেন, ‘এ বিষয়ে বাংলাদেশকে সফল করতে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার দফতর সবকিছু করতে প্রস্তুত রয়েছে।’

তিনি মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার লক্ষ্যে বাংলাদেশের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেয়া সাম্প্রতিক বিবৃতিকে স্বাগত জানান।

তুর্ক প্রধান উপদেষ্টার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সকল প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবেলার গুরুত্ব উল্লেখ করেন।

তিনি বিচার বিভাগ, নির্বাচনী ব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ, সাংবিধানিক বিষয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের সুপারিশ করার লক্ষ্যে দ্রুত বিভিন্ন কমিশন গঠনের প্রশংসা করেন।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রম অধিকার এবং নারীবিষয়ক সমস্যা সমাধানের জন্য অতিরিক্ত কমিশন গঠন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

তিনি বলেন, ‘আজকের বেশ কয়েকজন কমিশনারের সাথে আমার আলোচনায় আমরা আস্থা-নির্মাণ, অন্তর্ভুক্তিকরণের গুরুত্ব এবং একই ধরনের সমস্যা আক্রান্ত অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ যে শিক্ষা নিতে পারে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি।

তিনি বলেন, এসব সংস্কার বাংলাদেশে কয়েক দশকের তীব্র রাজনৈতিক বিভাজন কমিয়ে আনার এবং পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতিকে দমন করার জন্য একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ হতে পারে যা এর গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘জুলাই ও আগস্টে নিহত ও গুরুতর আহত বিক্ষোভকারী এবং শিশুসহ অন্য জনগণের বিরুদ্ধে নৃশংস সহিংসতার বিচারের প্রয়াস অগ্রাধিকার পাবে।’

তুর্ক বাংলাদেশের সকল হত্যাকাণ্ডের তদন্তের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে সমাবেশের ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুরক্ষার আহ্বান জানান।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেকোনো হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হওয়া দরকার। আমরা হত্যাকাণ্ড ঘটতে দিতে পারি না।’

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সদস্য বা সমর্থকদের বিরুদ্ধে কেবল তাদের আগের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার ভিত্তিতে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা সমীচিন নয়।

জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার প্রধান সতর্ক করে বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অসংখ্য হত্যার অভিযোগসহ কিছু অভিযোগ যথাযথ তদন্তে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণে উদ্বেগ রয়েছে। ‘অতীতের দৃষ্ঠান্তের পুনরাবৃত্তি না করা গুরুত্বপূর্ণ।’

‘ব্যাপক সংখ্যায় মিথ্যা মামলা দায়ের করার বিষয়টি মোকাবেলা করার একটি হাতিয়ার হিসাবে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক একটি কমিটি গঠনকে তুর্ক স্বাগত জানিয়ে বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দেয়া অপরিহার্য।’

তুর্ক বলেন, ফৌজদারি বিচার করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে যাতে অভিযোগ আনা না হয় এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ (আইসিটি) সকল পর্যায়ে যথাযথ প্রক্রিয়া ও ন্যায্য বিচারের মান বজায় রাখা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার অতীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হবে।’

ভবিষ্যতে মৃত্যুদণ্ডের প্রয়োগ নিয়েও জনসমক্ষে আলোচনা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি, আইন ও প্রমাণের তথ্যের ভিত্তিতে স্পষ্ট, মৃত্যুদণ্ড অতীতের বিষয় হওয়া উচিত।’

তিনি বলেন, ছাত্ররা তাকে জানিয়েছেন যে তাদের উদ্বেগ শোনার জন্য দেশে কোনো ব্যবস্থা না থাকায় রাস্তায় নামা ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, ‘সামাজিক সংহতি এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা পুনরুদ্ধার করার জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অব্যাহতভাবে কণ্ঠরোধ হয়ে যাওয়া নাগরিক অবস্থানের পুনর্গঠন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। এ জন্য ভিন্নমত রোধ করাসহ দমনমূলক আইনগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার প্রয়োজন হবে।

তিনি বলেন, শুধু পদ্ধতিগত পরিবর্তনই নিশ্চিত করবে যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকারকে সম্মান করা হবে।

তুর্ক সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মতপ্রকাশের অপরাধের পুরানো মামলা প্রত্যাহারের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।

হাইকমিশনার বলেন, ‘একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি, যেখানে শ্রেণী, লিঙ্গ, জাতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ, পরিচয় বা ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি কণ্ঠস্বর শোনা যায় এবং মূল্যায়ন করা হয়, তা মুখ্য হবে। আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা ও বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে যা এই পরিবর্তনের জন্ম দিয়েছে।’

জুলাই মাসের বিক্ষোভসহ সামাজিক ন্যায়বিচার আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে নারীরা ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারীদের অবশ্যই উত্তরণের সময় এবং তার পরেও অগ্রভাগে থাকতে হবে।

তিনি বলেন, ‘সংস্কার কাঠামোতে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সেইসাথে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি সংখ্যালঘুদের রক্ষায় ছাত্র এবং অন্যদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন।

তুর্ক বলেন, যেকোনো দমন-পীড়ন, অভ্যুত্থান ও সহিংসতার পর এগিয়ে যাওয়ার জন্য সত্য প্রকাশ ও ক্ষত কাটিয়ে ওঠার একটি জাতীয় প্রক্রিয়া থাকা দরকার।

ভুক্তভোগীদের তাদের প্রিয়জনদের এবং সমাজে বৃহত্তর সমাজের বেদনা এবং ক্ষোভের জন্য একটি ব্যাপক পদ্ধতির প্রয়োজন যাতে ন্যায্য অপরাধমূলক বিচার, সত্য-সন্ধানী প্রক্রিয়া, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ এবং ইতিহাসকে স্মরণ ও সংরক্ষণের উদ্যোগ অন্তর্ভুক্ত থাকে।

তুর্ক গুম সংক্রান্ত সনদে বাংলাদেশের অনুমোদন এবং একটি তদন্ত কমিশন নিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছেন।

জাতিসঙ্ঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন গত ৫ থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ তদন্ত করছে।

তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা বাড়ানোর জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত এবং জবাবদিহিতার ব্যবস্থাসহ এই ধরনের ঘটনার জন্য কর্তৃপক্ষের অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে সামাজিক মিডিয়াতে ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তি ও ঘৃণামূলক প্রচারণার প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা গড়ে তুলতে হবে।’

অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আইনের শাসন নিয়ে উদ্বেগসহ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যে চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখীন হয়েছে, তা স্বীকার করে তুর্ক সাম্প্রতিক ছাত্র বিক্ষোভের ফলে পরিবর্তনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ‘মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতি উপলব্ধি করার জন্য সাহস ও সহিষ্ণুতার প্রয়োজন হবে, তবে এটি আস্থা বৃদ্ধি করবে এবং বদ্ধমূল বিভাজন নিরসনে সহায়তা করবে।’

তিনি মানবাধিকারকে এসব পরিবর্তনের দিশারী হিসাবে পরিচালনা করার গুরুত্বের ওপর জোর দেন।

তিনি বলেন, ‘আমি উৎসাহিত হয়েছি যে আমার অনেক আলোচনায়, জোরদার উপস্থিতির মাধ্যমে আমার দফতরের বর্ধিত সমর্থনের আহ্বান জানানো হয়েছে। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে বাংলাদেশে আমাদের বর্ধিত উপস্থিতির পদ্ধতির ওপর আলোচনা শেষ করার অপেক্ষায় রয়েছি।’

তিনি এ বছরের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন মোতায়েন করার জন্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আমন্ত্রণকে অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ বলে অভিহিত করেন।

দুই দিনের সফর শেষ করার আগে তুর্ক প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও উপদেষ্টাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
সূত্র : বাসস


আরো সংবাদ



premium cement