১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বহুমাত্রিক সাহিত্যিক হোসেনউদ্দীন হোসেন

-

কৃষি ও সাহিত্যের মেলবন্ধনেই ছিলেন হোসেনউদ্দীন হোসেন। ৮৩ বছরের বিশুদ্ধতাময় সবুজাভ আয়ু পেয়েছিলেন। ২০২৪-এর ২০ মে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চিরবিদায়। যেন নিভৃত যাপনে সুরভিত প্রগাঢ়-প্রয়াণ

‘শান্তির নামে যারা পায়রা উড়িয়ে দিলো
বন্দুকের নলে তারা ঝাঁঝরা করে দিলো
মানুষের বুক

চলো আজ ভোরের আলোয়
সমুদ্রের কোলে গিয়ে শোক সভা করি।

চলো আজ সমুদ্র জলে
স্নান করে আসি

চলো আজ পবিত্র গ্রন্থ ছুঁয়ে
মন্ত্র পাঠ করি,
মানবজীবন সত্য হোক
দানবের হোক মৃত্যু।"
( চলো যাই)

লেখক হোসেনউদ্দীন হোসেনের শান্তিবাদী কবিতার উদ্ধৃতি। আশির দশকে যুদ্ধবিরোধী কবিতার চর্চা ছিলো প্রবল। বিশ্বব্যাপী ‘ন্যাটো ও ওয়ারশ’ সামরিক জোটের পারস্পরিক উত্তেজনা। পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা কবি ও সংস্কৃতিসেবীদের ভাবিত করে। কবি আল মাহমুদের সম্পাদনায় বেরুল ‘আফগানিস্তান আমার ভালোবাসা’। যুদ্ধবিরোধী প্রবন্ধ-নিবন্ধ-কবিতার বাছাই সঙ্কলন। মার্কিন শান্তিকন্যা সামাস্থা স্মিথ রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত। ‘দৈনিক সংবাদে’ আমাকে লিখতে হলো শান্তিকামী কবিতা। মফঃস্বলে থাকা কথক-গবেষক হোসেনউদ্দীন হোসেনও বাক্যমালা গেঁথেছিলেন।
আশি দশকের মধ্যভাগে চিঠিতে চিঠিতে সংযোগ। এই লেখকের গুণপনার কথা জানিয়েছিলেন কবি রফিক আজাদ। বাংলা একাডেমির ‘উত্তবাধিকার’ সম্পাদনার চাকরি ছাড়লেন রফিক ভাই। ইত্তেফাক ভবনের ‘সাপ্তাহিক রোববারে’ যুক্ত হলেন। দেখেছি, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে অধীনস্থদের পরামর্শ দিতেন। বলতেন রাজধানীর বাইরেও অনেক ঋদ্ধ লেখক আছেন। বিশেষ ও সাধারণ সংখ্যাগুলোয় তাদেরও গুরুত্ব থাকা চাই। তালিকা দিতে গিয়ে হোসেনউদ্দীন হোসেন-এর কথাও বলেন।
১৯৮৪-তে আমি প্রথমশ্রেণীর একটি দৈনিকের ফিচার ইন-চার্জ। সাহিত্য, শিশুসাহিত্য, মহিলা পাতাও সমন্বয় করি। ফলে প্রতি সপ্তাহে প্রচুর পরিমাণে লেখা সংগ্রহের চাপ। আমিও সিদ্ধান্ত নেই... অর্ধেক লেখাই নেব মফস্বল থেকে। রাজধানীর লেখকদের ব্যস্ততা বেশি, সম্মানীর পরিমাণও বেশি অঙ্কের। আমি সাত তাড়াতাড়ি একটি তলিকা তৈরি করি। রাজশাহী থেকে হাসান আজিজুল হক, আবুবকর সিদ্দিক। কবি আতাউর রহমান, জুলফিকার মতিন, তসিকুল ইসলাম রাজা, প্রমুখ। যশোর থেকে কবি আযীযুল হক, হোসেনউদ্দীন হোসেন...। ময়মনসিংহের যতীন সরকার, চট্টগ্রাম থেকে ডা. আনিসুজ্জামান, স্বপন দত্ত...।

সেই চিঠিযুগের লেখক হোসেনউদ্দীন হোসেনের ঠিকানাটি এখনো স্মৃতিময়। গ্রাম: কৃঞ্চনগর, পোস্ট (উপজেলা) ঝিকরগাছা, জেলা : যশোহর। চমৎকার হাতের লেখায় প্রবন্ধ পাঠাতেন। রবীন্দ্র বিষয়ক প্রবন্ধ/নিবন্ধই বেশি। যেগুলো সঙ্কলিত করে উপহার দেন 'অনন্য রবীন্দ্রনাথ' বইটি। ১৫ টি প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২৮, প্রকাশক কথাপ্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা, গদ্যকবিতা, রাজনৈতিক সচেতনতার বিশ্লেষণ। প্রবন্দ্রগুলো রবীন্দ্রভক্ত-শাসিত পশ্চিমবঙ্গেও সমাদর পায়।
ষাট দশকের বিশ্লেষণবাদী লেখক হোসেনউদ্দীন হোসেন। ষাটের দশকে সাংবাদিকতা দিয়ে পেশাজীবনের শুরু। যদিও বেশিটাই কৃষি জমির ফসল উৎপাদনে তথা গেরস্থালীতে। ফলে সমাজকে তিনি পাঠ বা অবলোকন করতেন অবলীলায়। সৃষ্টিকর্মে লালন করতেন বহুমাত্রিকতা। লিখতে পেরেছেন ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস। তবে সর্বাধিক কাজ গবেষণা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ বিষয়ক। উল্লেখযোগ্য বই : যশোরাদ্য দেশ (১৯৭৪), যশোর জেলার কিংবদন্তী (১৯৭৪, দুই খণ্ড)। অমৃত বৈদেশিক (১৯৭৫), ভলতেয়ার ফ্লবেয়ার তলস্তয় : ত্রয়ী উপন্যাস। যুগমানস (১৯৮৮), বাঙলার বিদ্রোহ (২০০৩, ২০০৬ দুই খণ্ড)। নষ্ট মানুষ (উপন্যাস, ১৯৭৪), প্লাবন এবং একজন নূহ (১৯৭৯)। এই উপন্যাসটি ইংরেজিতে ‘Flood And A Nooh’ নামে অনূদিত হয়। ইংল্যান্ডের মিনার্ভা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিতও হয়েছে। আরেকটি উপন্যাস ‘ইঁদুর ও মানুষেরা’ ইংরেজিতে বেরোয় ‘MICE AND MEN’ নামে।
১৯৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন হোসেনউদ্দীন হোসেন। যুদ্ধমুক্ত কেমন বাংলাদেশ চান... সে বিষয়ে লিখেছেন
‘শান্তি সুখ ভালোবাসা প্রেমপ্রীতি দয়ামায়া
উড়ে উড়ে যাচ্ছে বাতাসে
দুঃখগুলো হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটছে বুকের চাতালে ...

ব্যক্তি নয় বিভাজন নয়
সীমাবদ্ধ নয়
পূতপবিত্র আলোয় ভরে উঠবে খোলা ময়দান
খোলা আকাশের তলে

মুক্ত হয়ে দাঁড়াবে মানুষ
সকলেই সমান সমান’
(মুক্ত হয়ে দাঁড়াবে মানুষ)

কর্মের তুলনায় পদক-সম্মাননার সংখ্যা আনেক কম। পেয়েছেন : চাঁদেরহাট পদক (১৯৯০), মহম্মদ শহীদুল্লাহ স্মৃতিপদক (১৯৯৬)। এছাড়া বিজয় দিবস পদক (১৯৯৭), মাইকেল মুধুসূদন একাডেমি পদক (২০০১) ইত্যাদি। অবশেষে ২০২১-এ গবেষণায় পান বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ২০২৪-এর ২০ মে প্রয়াণপূর্বকালের প্রণোদনা এটি।
মফঃস্বল লেখকদের জাতীয় পদক-পুরস্কার বিষয়ে ক্ষোভ থাকে। প্রাপ্তির ক্ষেত্রে রাজধানীর লেখক, সংস্কৃতিসেবীরাই প্রাধান্য পান। এ বিষয়ে শ্রদ্ধেয় হোসেন ভাই-এর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ১৯৯৯ সালে যশোর হয়ে ঝিকরগাছার বাড়িতে গিয়েছি। এলাকার এমপি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তখন বিদ্যুৎ-জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী। পূর্বে তিনি ছিলেন বাংলার অধ্যাপক, আমার ঘনিষ্ঠজন। রফিক ভাই ছেলে আশিককে দিয়ে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করান। সেবার চিংড়ি ও কচুর লতি দিয়ে আকস্মিক মধ্যাহৃভোজ।
হোসেন ভাই তখন জাতীয় পত্রপত্রিকার নিয়মিত লেখক। কবি আহসান হাবীব সম্পাদিত ‘দৈনিক বাংলা সাহিত্য’। কবি আল মুজাহিদী সম্পাদিত ‘দৈনিক ইত্তেফাক সাহিত্য’। লেখক আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘সংবাদ সাময়িকী’। কবি নাসির আহমেদ সম্পাদিত ‘দৈনিক জনকণ্ঠ সাহিত্য’। সাপ্তাহিক বিচিত্রা, রোববার শৈলী, ভোরের কাগজ-- কোথায় নেই তিনি। কিন্তু ছিলেন না জাতীয় বা স্থানীয় পদক-পুরস্কারের তালিকায়। ফরিদপুরের 'আলাওল', খুলনার ‘কবিতালাপ’ বা যশোরের ‘সুহৃদ’। ঢাকার কবি-লেখকেরা পুরস্কৃত হলেও হোসেন ভাই ছিলেন অবহেলিত।
উল্লিখিত বিষয়টি উপস্থাপিত হলে তিনি একটু হেসেছিলেন। বলেন, লেখনশিল্পে প্রাপ্তি বিষয়ে অস্থির হওয়ার কিছু নেই। পাবনার কবি ওমর আলীও বাংলা একাডেমি পেয়েছেন। আমি যোগ করি, সেটি তো অনেক আগের কথা। ১৯৮১ সালে, ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ কাব্যগ্রন্থে। সেবার ঢাকা থেকে কবি রফিক আজাদও পুরস্কারটি পেয়েছিলেন।

অত:পর আরেকটি গোপন তথ্য প্রকাশ করলেন হোসেন ভাই। বললেন, আমার বসবাস একবারে যশোরের সীমান্ত এলাকায়। ঢাকার পাশাপাশি কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের কাগজেও লিখি। দৈনিক সত্যযুগ, লোকসেবক, নন্দন ইত্যাদিতে লিখছি। ফলে বাংলাদেশের অনেকে আমাকে দ্বিখণ্ডিত করে। বলে, তিনিতো ওপার বাংলার লেখক। পুরস্কার সম্মাননা ওপার থেকেই সংগ্রহ করুক। এখন বলো তো, আমি পদক সংগ্রহে মাঠে নামব? আমাকে দিয়ে ওসব ধরাধরি লড়ালড়ি হবে না। আমি আমার দায়িত্ববোধ থেকে লেখালেখির চেষ্টা করি। পাঠকের পরিতূপ্তির মধ্যেই আমার প্রশান্তি নিহিত। পদক-পুরস্কারের লোভটা মাথায় ঢুকলে মহৎ সাহিত্য ধরা দেবে না।
ঝিকরগাছার কালীগঞ্জ গ্রামের টালিছাদ বাড়িটিতেই শতভাগ জীবনযাপন। কৃষিভূমির সবুজশস্য আর ঋদ্ধ সাহিত্য ফলাতেন। যেভাবে ‘ব্রিটিশ রাজকবি’ টেড হিউজ ‘ডেভন গ্রামে’ স্থায়ী হয়েছিলেন। বাদাম ও কবিতা চাষে যুগপৎ নিমগ্ন থাকতেন। ১৯৮৯-এর নভেম্বরে দুর্লভ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। বলেছিলেন, শস্য ও সাহিত্য : দুটোর যুগপৎ উৎপাদন অত্যন্ত সুখকর। ফসলের নতুন ডগা আর সাহিত্যে সৃষ্টিময় শব্দাবলী...। একবার কেউ ধারণ করতে পারলে সে প্রশান্তিময় আয়ুর রাজা।
কৃষি ও সাহিত্যের মেলবন্ধনেই ছিলেন হোসেনউদ্দীন হোসেন। ৮৩ বছরের বিশুদ্ধতাময় সবুজাভ আয়ু পেয়েছিলেন। ২০২৪-এর ২০ মে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চিরবিদায়। যেন নিভৃত যাপনে সুরভিত প্রগাঢ়-প্রয়াণ। বিদায়ের আগে নতুন প্রজন্মের জন্যে লিখে গেছেন ছায়া-এপিটাফ
‘পোয়াতি রমণীর মত অবসাদে শুয়ে আছে মাঠ,
চাষার লাঙলের ফালে ছড়ানো শস্যবীজ
বৃষ্টি রৌদ্র হাওয়ায় জন্মেছে তার গর্ভে ভ্রুণ।
মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে অঙ্কুর নতুন।

দেহে তার মেখে আছে সূর্যের খুন
লাঙলের তাড়ায় ছিলো হাতের আগুন।

শিকড়ের শিরা গেছে মাটির অতলে
অঙ্কুরে লেগে আছে ঘাম আর নুন।’


আরো সংবাদ



premium cement