১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩০, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিজরি
`

স্মৃতিতে হুমায়ূন আহমেদ সোয়াচান পাখি

-

ড. হুমায়ূন আহমেদ আমার থেকে ১০ বছরের সিনিয়র। তিনি জন্মে ছিলেন ১৯৪৮ সালে আর আমি ১৯৫৭ সালে। তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের নামকরা এবং জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন তিনি।
তিনি ১৯৬৫ সালে বগুড়া জেলা স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে রাজশাহী বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে বিএসসি অনার্সে ও এমএসসিতে প্রথম শ্রেণীতে পাস করেছিলেন।
তারপর তিনি ১৯৭৩ সালে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং এর পরের বছর ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি ছাত্রজীবনে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে তিনি উপন্যাস লেখা শুরু করেন। এর আগে বালক বয়সে তিনি অবশ্য কবিতা লিখেছিলেন। কী কবিতা লিখেছেন, কোথায় সেগুলো, ছাপা হয়েছিল কি না তা আজ গবেষণার বিষয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে তিনি নভেলা বা নাতিদীর্ঘ উপন্যাস লেখা শুরু করেন। এ সময়ে তিনি তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ লিখেন। এটি ১৯৭২ সালে প্রকাশ পায়। এরপর বের হয় তার কালজয়ী উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’। এটি প্রকাশ পায় ১৯৭৩ সালে।
এরপর তিনি পিএইচডি ডিগ্রির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং সাফল্যের সাথে পলিমার কেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
এ সময়ে তার লেখায় সাময়িক বিরতি ঘটলেও পরবর্তী সময়ে তিনি প্রায় তিন শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী, ভৌতিক গল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস বা সিরিজ নভেলা, কিছু কালজয়ী গান, নবী জীবনীসহ সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়।
হুমায়ূন আহমেদ শহরে, প্রবাসজীবনে বেড়ে উঠলেও তার হৃদয়ে প্রোথিত ছিল হাওর বাংলা নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট অঞ্চলের লোক ঐতিহ্য, ফোক গান, বাউলিয়ানা, মরমি আধ্যাত্মিকতা।
তার রক্তে গুঞ্জন তুলত হাসনরাজা, শাহ আবদুল করিম, রাধারমণ, উকিল মুন্সীর মরমি গান।
তার আধুনিক মননের সাথে বাউল গানের যে মিথস্ক্রিয়া হয়েছিল তার বিকাশ ঘটেছিল তার শেষজীবনে।
জীবনের শুরুতে যে ভাবালুতা কবিতার আবেগ মধুমায়া সৃষ্টি হয়েছিল তার পরিণতি দেখি তার গীতিকবিতায়।
২. ধারণা করা হয়, তিনি টিভি নাটক এবং চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে গান রচনায় হাত দিয়েছিলেন। গান লেখার জন্য তিনি কোনো বিখ্যাত গীতিকারের শরণাপন্ন হতে পারতেন কিন্তু তিনি যে ভাব ও ভাষায়, বাণী ও গায়কীতে গান চান তা হয়তো তাদের মাধ্যমে সম্ভব হতো না। তাই তিনি গান লেখায় হাত দিলেন এবং সফল হলেনই নয়; বরং কিছু কালজয়ী গান রচনা করলেন, যা আমাদের সাহিত্যে লাখো বছর টিকে থাকবে।
তিনি শুধু চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখেননি; বরং আমাদের বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন।
সঙ্গীতের বাণী আর সুরে তিনি অধুনা-মরমি মিশ্রণে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন।
তার উপন্যাস ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ তিনি চলচ্চিত্রায়ন করেন এবং দু’টি অসাধারণ গান রচনা করেন। একটি গানের উদ্ধৃতি-
‘এক যে ছিল সোনার কইন্যা
মেঘ বরণ কেশ
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ
দু’চোখে তার আহা রে কি মায়া
নদীর জলে পড়ল কন্যার ছায়া।
তাহার কথা বলি,
তাহার কথা বলতে বলতে
নাও দৌড়াইয়া চলি।

কন্যার চিরল চিরল চুল
তাহার কেশে জবা ফুল
সেই ফুল পানিতে ফেইলা
কন্যা করল ভুল,
কন্যা ভুল করিস না,
ও কন্যা ভুল করিস না
আমি ভুল করা কন্যার লগে কথা বলব না।

হাত খালি, গলা খালি, কন্যার নাকে নাকফুল
সেই ফুল পানিতে ফেইল্যা কন্যা করল ভুল
কন্যা ভুল করিস না, ও কন্যা ভুল করিস না।

এখন নিজের কথা বলি,
নিজের কথা বলতে বলতে
নাও দৌড়াইয়া চলি।

সবুজ বরণ লাউ ডগায়
দুধ সাদা ফুল ধরে,
ভুল করা কন্যার লাগি মন আনচান করে
আমার মন আনচান করে।’
এই গানটি গেয়ে সুবীর নন্দী শ্রেষ্ঠ পুরুষ কণ্ঠশিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০০৬ সালে তার কিছু উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়। মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ‘দূরত্ব’ বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘নন্দিত নরকে’ আবু সায়ীদ পরিচালিত ‘নিরন্তর’ প্রভৃতিতে তিনি গান রচনা করেন।
২০০৭ সালে শাহ আলম নির্মাণ করেন ‘সাজঘর’ তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেন ‘দারুচিনি দ্বীপ’। ত্রিভুজ প্রেমের গল্প নিয়ে রচিত হয়, ‘আমার আছে জল’।
এর জন্য হুমায়ূন আহমেদ রচনা করেন একটি অসাধারণ কাব্যিক গান-
‘নদীর ময়ূরাক্ষী নামটি
কাক কালো জল,
কোন ডুবরি সেই নদীটির
পায়নি খুঁজে তল’...
তিনি নাটকে চলচ্চিত্রের জন্য অনেক গান রচনা করেছেন।
তার কিছু বিখ্যাত গানের প্রথম কলি তুলে ধরছি-
- একটা ছিল সোনার কন্যা...
- যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো এক বরষায়...
- ও আমার উড়াল পঙ্খিরে, যা যা তুই উড়াল দিয়া যা...
- চলো না যাই...
- আজ জরির বিয়ে...
- ও আমার রসিক বন্ধুরে...
- আমার ভাঙা ঘরের ভাঙা চালা
- মাথায় পরেছি সাদা ক্যাপ...
- কন্যা নাচিল রে...
- ঠিকান আমার নোট বুকে আছে...
- বাজে বংশি...
- বরষার প্রথম দিনে...
- আমি আজ ভেজাব চোখ সমুদ্র জলে
- চান্নি পসরে কে আমারে স্মরণ করে
- চান্নি-পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়...প্রভৃতি।
হুমায়ূন আহমেদ স্যারের গানের সুরকার ও শিল্পীরা হলেন- মোকসেদ জামিল মিন্টু, সেলিম চৌধুরী, বারী সিদ্দিকী, সুবীর নন্দী, এস আই টুটুল, মেহের আফরোজ শাওন, সাবিনা ইয়াসমিন, খান আসিকুর রহমান আগুন, হাবিব ওয়াহিদ ও ফজলুর রহমান বাবু প্রমুখ।


আরো সংবাদ



premium cement