সায়ীদ আবুবকরের কাব্যকৃতি
- নাজিব ওয়াদুদ
- ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০৫
দশক বিচারে সায়ীদ আবুবকর বিংশ শতাব্দীর নব্বই দশকের কবি। এই কালপরিসরে যেসব কবির উত্থান তাদের কবিতায় কিছু বিষয়গত সমলক্ষণ রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে- এরা প্রায় সবাই একই সাথে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। ঐতিহ্য ও আধুনিকতা অনেকসময় পরস্পরের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে যা কবিতাশিল্পের জন্য ক্ষতিকারক, বিব্রতকর তো বটেই। কারণ ঐতিহ্যের সাথে অতীত জড়িত, আর আধুনিকতা সমকালপ্রবণ। ঐতিহ্যের চর্চা অনেকসময় অতীতচারিতা বা অতীতমুখিতায় পর্যবসিত হতে পারে, আবার আধুনিকতার চর্চার ইতিহাসবিচ্ছিন্ন এবং যান্ত্রিকতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। নব্বই দশকের কবিদের অনেকের মধ্যেই ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এই সীমাবদ্ধতাগুলো প্রকটিত হয়েছে। যে কয়জন তাকে অতিক্রম করতে পেরেছেন তাদের মধ্যে সায়ীদ আবুবকর অগ্রগণ্য। তার সাফল্য এই যে, তিনি ঐতিহ্য ও আধুনিকতাকে পরিপূরক করে বিন্যস্ত করতে পেরেছেন। সে জন্য তিনি ঐতিহ্যবাদী হয়েও সম্পূর্ণ আধুনিক। কয়েকটি উদাহরণ পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে।
সায়ীদ আবুবকর প্রায়ই ঐতিহ্য ও সমকালকে দেখেছেন অবিচ্ছেদ্য আকারে, জীবন ও ইতিহাসের বিকাশপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। তাই অতীতের সাথে বর্তমানের কোনো বিচ্ছিন্নতা থাকে না।
কি-আশ্চর্য এই জল, এই বৃষ্টিপাত
কোথায় আকাশে ছিল, শূন্যের গহ্বরে-
ঊর্বশীর মতো এলো নেমে সে হঠাৎ
ফসলের মাঠ আর ধু-ধু তেপান্তরে;
...
যে-ছিল আকাশ পারে, শূন্যের খাঁচায়,
সে এখন মর্ত্যলোকে নাচে ও নাচায়।
(বৃষ্টি, তোমার পৃথিবী চালায় দস্যুরা)
কিংবা
একটাই বটগাছ ছিল আমাদের গোটা গ্রামে,
তার সব ডালে বসে নিত ক্লান্ত পাখিরা বিশ্রাম;
...
সেই বটগাছে চড়ে দেখা যেত দূর-দূরান্তর,
পৃথিবীটা মনে হতো আমাদের মুঠোর ভেতর;
কারা সেই গাছ কেটে তুলল সেখানে নাচঘর!
সেই ঘরে নাচে আজ বাটপার, জল্লাদ ও চোর।
আসে না আর সে পাখি, ভাসে না বাতাসে সেই সুর
ঘেউ ঘেউ করে শুধু গ্রামময় অজস্র কুকুর।
(একটাই ছিল বটগাছ, তোমার পৃথিবী চালায় দস্যুরা)
তার কবিতায় প্রেম ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন এক নতুনতর আধুনিকতা নির্মাণ করে, কখনো কখনো তা ব্যক্তিকতাকেও আক্রান্ত করে। যেমন-
হাবিল কি আমার চেয়েও বেশি পারত তোমাকে ভালোবাসা দিতে, আকলিমা?
হাবিল কি আমার চেয়েও বেশি সুপুরুষ ছিল, যুদ্ধবাজ, প্রেমবাদী?
হাবিল কি আমার চেয়েও প্রেমের কাঙাল?
(প্রণয়ের প্রথম পাপ, প্রণয়ের প্রথম পাপ)
আবার তার ঐতিহ্যচেতনা ও ব্যক্তিকতাবোধ দেশজতা ও আন্তর্জাতিকতাকে নিবিড়ভাবে ধারণ করে।
আমি মমতাজ আর হেলেনের চোখ নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর এক কোণে
সর্বাঙ্গে আমার শাপলা ফুলের ঘ্রাণ আর ছলাৎ ছলাৎ করে বঙ্গোপসাগর বঙ্গজ আমার মনে।
(জীবন জিন্দাবাদ, এবার একটিবার একসাথে)
ঐতিহ্য, আধুনিকতা ও মানবজীবনের দ্বান্দ্বিকতা কিভাবে ব্যক্তিক চেতনা ও অনুভূতিকে জারিত করে তার উদাহরণ-
তোমাকে দেখলে আমাদের মনে পড়ে যায় সিরাজউদদৌলার
কথা, শরতের দেবদাসের কথা ও মানিকের মাঝি কুবেরের
আর শেক্সপিয়ারের কিংলিয়ারের কথা শুধু মনে পড়ে-
কারণ এসব মহান চরিত্রে দেখেছি তোমার অপূর্ব অভিনয়।
কেবল একটিবারও তোমার কথাটি পড়ে না আমাদের মনে
কারণ তুমি যে তোমাকে হারিয়ে অন্যের জীবন বয়ে গেছ আজীবন।
(প্রখ্যাত এক অভিনেতার প্রতি, এবার একটিবার একসাথে)
আধুনিককালের যুদ্ধ ও শোষণের ভয়াবহতাকে উন্মুক্ত করতেও তিনি তার ঐতিহ্যচেতনাকে কাজে লাগিয়েছেন।
উজান বাতাসে উত্তরীয় ছুড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে-নারী,
নড়েচড়ে উঠল ইতিহাস, নেবুচাদ নেজারের ঝুলন্ত উদ্যান আর সুরম্য হারেম;
মসলিন শাড়ির মতো তার মুখ দেখে আমি ঠিকই চিনে নিতে পারি
কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া সে এক মেসোপটেমিয়ার মেম।
কী ভেবে, মুঠের ভেতরে হঠাৎ, গুঁজে দিয়ে মহামূল্য তার কারুজ হৃদয়
বলে উঠল সে কানে কানে, ‘যেন কস্মিনকালেও না জানতে পারে কেউ গুপ্ত এই বৈভবের কথা।...’
বলতে বলতে উঠল সে ঘেমে, আমি তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি মহা হতবাক
তিকরিতে বাগদাদে বসরা ও মসুলে তখন পতিতাপল্লীর মতো পুড়ছে ইরাক।
(মেসোপটেমিয়ার মেম, মেসোপটেমিয়ার মেম)
সায়ীদ আবুবকরের এ রকম আরো অনেক কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখানো যায় তিনি ব্যক্তিকতা, দেশজতা, মানবিকতা, স্রষ্টাপ্রেম ও বিদ্রোহকে কিভাবে ঐতিহ্যলগ্ন এবং আধুনিক অভিব্যক্তিতে একই সাথে সমকালীন ও সর্বজনীন করে তুলেছেন।
সায়ীদের আরেকটি লক্ষণীয় প্রবণতা হচ্ছে, তিনি কবিতাকে ছন্দের বাঁধনে বেঁধে তাকে ছন্দিত, স্পন্দিত ও গতিমান করেন। তিনি নতুন কোনো ছন্দ আবিষ্কার করেননি, হয়তো সেটি আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তার কৃতিত্ব এই যে, তিনি সব প্রকার ছন্দকে বিচিত্রভাবে ব্যবহার করেছেন এবং এ বিষয়ে যথেষ্ট উৎকর্ষ ও দক্ষতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। সেটি একটি কারণ যে, তার গদ্য কবিতাও সুপাঠ্য ও গতিময়তায় সাবলীল।
বাংলা কবিতায় গতিময়তার সার্থক ব্যবহার সর্বপ্রথম করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তারপর তার সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটান কাজী নজরুল ইসলাম। ফররুখ আহমদও এ ক্ষেত্রে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। আল মাহমুদ এদের মতো উচ্চকিত না হলেও শব্দচয়ন, পর্ব ও পঙ্ক্তি নির্মাণ এবং ছন্দের পরিকল্পিত ব্যবহার দিয়ে তার কবিতাগুলোকে গতিমান করেছেন। সায়ীদ মূলত মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং অংশত আল মাহমুদের উত্তরসূরি। তার মধুসূদন চর্চা (ইংরেজিতে লেখা কবিতার বাংলা অনুবাদ) থেকে অনুমান করা যায়, তিনি তার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ এবং আল-মাহমুদের প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না। তবে সায়ীদ আবুবকরের প্রথম দিককার কবিতাগুলো গভীর মনোযোগ ও বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে অনুধাবন করা যাবে, তার কবিতার বয়ান-প্রকৌশলে পবিত্র কুরআনের বাগভঙ্গির প্রভাব রয়েছে। এই বাগভঙ্গিতে যেমন ছন্দোময়তা আছে, তেমনি আছে কর্তৃত্ববাদী আত্মবিশ্বাসের চাপ যা একধরনের গতিময়তা ও সম্মোহনী আবেশ তৈরি করে। এখানেই তার স্বাতন্ত্র্য নির্মিত হয়েছে। যেমন-
যে যা-ই বলুক, তুমি কেন বললে না ভালোবাসা পাপ নয়?
তুমি কেন প্রণয়ের এজলাসে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে বললে না একটিবারও:
যে ভালোবাসে সে খুনি হয়, অগ্নি হয়, ঝড় হয়, জলোচ্ছ্বাস হয়
পারো তাকে হত্যা করে ফ্যালো, নির্বাসনে দাও, কিন্তু কেউ পাপিষ্ঠ বলো না তাকে?
(প্রণয়ের প্রথম পাপ, প্রণয়ের প্রথম পাপ)
কবিতার এই বিশেষ বয়ানপ্রক্রিয়া কবির বক্তব্যকে বলীয়ান ও শাণিত করে যা পাঠকের মনতন্ত্রীতে সহজেই সঞ্চারিত হয়। সে কারণে এসব কবিতা পাঠককে আন্দোলিত, প্রাণিত ও সংক্রমিত করে। সায়ীদের অধিকাংশ কবিতাই এসব গুণে গুণান্বিত। এই বিশেষ কাব্যগুণ সহজলভ্য বা সহজসাধ্য নয়, এটি তাকে অর্জন করতে হয়েছে, কিন্তু কবিতায় প্রযুক্ত হওয়ার পর তা এতটাই সহজ, সাবলীল ও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে যে মনে হয় তা স্বতোৎসারিত, কবিকে এর জন্য কোনো কসরতই করতে হয়নি। কয়েকটি উদাহরণ উপভোগ করা যাক-
কি করে আমাকে হতে বলো, মেয়ে, প্রেমান্ধ কায়েস?
আমি তো দেখেছি সকালের রোদ বিকেলে এসেই রঙ উঠে যাওয়া শার্ট হয়ে যায়
ভোর না হতেই গনগনে চাঁদ পোড়া ব্যাটারির টর্চ হয়ে যায়
দেখেছি তো নীল নেশার চুরুট পুড়তে পুড়তে হয়ে যায় কত দ্রুত নিঃশেষ
(না-প্রেমিকের গান, প্রণয়ের প্রথম পাপ)
সায়ীদ আবুবকরের কবিতার ভাণ্ডার ইতোমধ্যেই বিশাল। কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৫। তার কবিতার বিষয়বৈচিত্র্য, বহুমাত্রিক কাব্যদৃষ্টি, শব্দ ও ভাষাচর্যা, কাব্যালঙ্কারের ব্যবহার, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়, প্রাকরণিক বাঁকবদল, ইত্যাদি নানান প্রসঙ্গ নিয়ে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। তার মহাকাব্য নবিনামা একটি অত্যন্ত বড় কাজ। এই অস্থির কাল-সন্ধিক্ষণে মহাকাব্যকে তিনি প্রাসঙ্গিক করে তুলতে চেয়েছেন। এটি শুধু দৈহিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশ্রমের কাজই নয়, তার এই উচ্চাভিলাষ প্রাকরণিক বিচারেও দুঃসাহসী। তিনি মহাকাব্যকে আধুনিকতা তথা সমকালীন জীবনযন্ত্রণা, মনন এবং সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নতুনতর উপলব্ধিতে পৌঁছতে চেয়েছেন। তার কৃতিত্ব এই যে, তিনি মহাকাব্যকে নতুনতর আঙ্গিক ও দৃষ্টিভঙ্গিতে চর্চা বা অধ্যয়ন করার পথরেখা তৈরি করে দিয়েছেন। ভবিষ্যতের কবিরা এই পথরেখা ধরে কোনদিকে কতদূর এগোবেন সেটি ভবিষ্যতের ব্যাপার। আমরা তার এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই এবং আশা করি তিনি আরো নতুন নতুন রচনা উপহার দিয়ে বাংলা কাব্যজগৎকে আরো সমৃদ্ধ করতে অবদান রাখবেন। সে যোগ্যতা তার আছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা