১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিদ্রোহী কবির রসবোধ

-

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের রসবোধ স¤পর্কে তার লেখনীর মাধ্যমে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। কবিকে যারা ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, তারা সবাই মুগ্ধ হতেন তার ভীষণ আয়েশী আড্ডাবাজ স্বভাব এবং রসবোধ নিয়ে। তার রসবোধের কিছু নমুনা নিচে তুলে ধরা হলো।
১.
নজরুলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল কিছু হিউমার ছিল। তিনি অৎরংঃড়পৎধঃব-এর বাংলা করেছিলেন, আড়ষ্টকাক! যারা বক্তৃতা দিতে ভালোবাসতেন তাদের বলতেন, বখতিয়ার খিলজি, কোনো কথার মোড় ঘুরিয়ে দিতে তিনি বলতেন, জানে দেও কন্ডাক্টর। কবি নজরুল ভঁহ এবং পানে সমান অভ্যস্ত ছিলেন। তার একটি বিখ্যাত পানপাত্র ছিল (যেটিকে তিনি নিজেই পানের সিন্দুক আখ্যা দিয়েছিলেন)। এই পানপাত্রে ১০০ পান থাকত। লিখতে লিখতে মাঝে মধ্যে একসাথে তিন-চারটি পান মুখে পুরতেন আর পিকদানিতে পানের পিক ফেলতেন। এই পান নিয়ে একটি মজার ঘটনা আছে।
একবার এক ভদ্রমহিলা নজরুলের পান খাওয়া দেখে তাকে খুব স্মার্টলি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা আপনি কি পানাসক্ত?
নজরুল বললেন, জি না, আমি বেশ্যাসক্ত!
নজরুলের এমন উত্তর শুনে ভদ্রমহিলার মুখ কালো হয়ে গেল। পরে নজরুল ব্যাখ্যা করলেন,
‘পান একটুু বেশি খাই তাই বেশ্যাসক্ত, অর্থাৎ বেশি+আসক্ত=বেশ্যাসক্ত!’
২.
বার্ষিক সওগাত বেরোবে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। হঠাৎ মজলিসে নজরুল বলে বসলেন-
১০ মাস মাসিক বেরিয়ে এখন বার্ষিক বেরোচ্ছে!
৩.
নজরুলের গান রচনার আর রেকর্ডের আঁতুড় ঘর ছিল কলকাতার বিষ্ণুভবন। সেখানে রিহার্সেল রুমে চা সাপ্লাই করতেন সুধীর নামে এক ব্যক্তি। তার প্রতি হুকুম ছিল প্রতি আধ ঘণ্টা পরপর কবির সামনে হাফ-কাপ চা রেখে যেতে। এই চায়ের রূপ দুধের স্বল্পতার কারণে কালচে-লালরঙ ছিল, তাই কবি এর নাম দিয়েছিলেন সুধীর বাবুর বদরক্ত!
৪.
একজন অবাঙালি ভদ্রলোক কবির খুব ভক্ত ছিলেন। কবিকে তিনি অনেক সময় অনেকভাবে সাহায্য করতেন। কোনো একদিন কলকাতায় কবির বাড়িতে কয়েকজন অভ্যাগতর সাথে কবি গল্পগুজব করছেন। সেই অবাঙালি ভদ্রলোকও ছিলেন। একসময় তার সাথে কবির হিন্দি বনাম বাংলা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা হচ্ছিল। ভদ্রলোকটি হিন্দি ভাষার জন্য ওকালতি করছিলেন। কবি হাসতে হাসতে বললেন, যাও! যাও! তোমাদের হিন্দি ভাষা তো কুকুর-শেয়ালের ভাষা!
শুনে ভদ্রলোকটি একটু ক্ষুণœ হয়ে বলে উঠলেন, কেঁও?
অমনি কবি বলে উঠলেন, ওই দেখ কুকুরের ডাক ডাকলে! ভদ্রলোকটি কবির কথায় রাগ না করে হেসে বললেন, হুয়াহুয়া!
কবি বললেন, ওই দেখ শিয়ালের ডাক ডাকলে, আমি ঠিক বলিনি?
উপস্থিত সবাই এই রসালাপে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লেন।
৫.
লোকের নাম নিয়েও ব্যঙ্গ করতেন নজরুল। তখনকার নূর লাইব্রেরির মঈনুদ্দীন হোসেনকে তিনি বলতেন, রয়টার। কারণ, হোসেন সাহেব যেকোনো খবর সবার আগে কলকাতার সব পত্রিকা অফিসে দিয়ে আসতেন। নজরুলের বন্ধু মোসলেম ভারতের আফজাল-উল-হককে তিনি ডাকতেন ডাবজল বলে।
শনিবারের চিঠির সজনীকান্ত দাসকে তিনি বলতেন সজনে ঘণ্ট খাস। মোহাম্মদী ও সওগাতের দ্বন্দ্ব যখন চরমে, নজরুলকে মোহাম্মদী যখন আজাজিল আখ্যা দেয়, তখন নজরুল আকরম খাঁর নাম দিয়েছিলেন বাগরমখাঁ। মোহম্মদ ওয়াজেদ আলীকে তিনি ডাকতেন বুড়ো বলে। কারণ তিনি যুবক হয়েও বুড়োদের মতো যুক্তি-তর্ক ছাড়া কথা বলতেন না। বিজলিধর নামে কবির এক ভক্ত
অটোগ্রাফ নিতে এলে তিনি লিখে দিলেন বি-জলি। মানে ইব লড়ষষু, অর্থাৎ হাসিখুশির মধ্যে থাকো!
৬.
একবার গ্রামোফোন কো¤পানিতে রেকর্ডে গান দিতে এলেন এক লোক। লোকটিকে নজরুলের কাছে পাঠানো হলো তার গানের দৌড় পরীক্ষা করার জন্য। লোকটি হারমোনিয়াম নিয়ে কবির সামনে বসলেন এবং গান শুরু না করে কথা শুরু করলেন। কার কাছে গান শিখেছেন, কবে তার গান শুনে কে প্রশংসা করেছে, তিনি কতখানি পাণ্ডিত্যের অধিকারী ইত্যাদি। মাঝে একবার কবিকে জিজ্ঞাসা করেই বসলেন, আপনি কি ধানশ্রী ভৈরবি রাগের গান শুনেছেন? শোনেননি বোধ হয়। খুব রেয়ার। কেবল আমার কাছেই আছে।
এভাবে লোকটি গান না গেয়ে বকবক করেই যাচ্ছিল। নজরুল তখন বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনি তো দেখছি একটি জানোয়ার লোক।
কী বললেন?
ভদ্রলোকটি নজরুলের কথায় বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। নজরুল বললেন, না না অন্য কিছ ুমনে করবেন না, দেখলাম আপনি অনেক কিছু জানেন, তাই আপনার সম্বন্ধে জানোয়ার শব্দটি প্রয়োগ করেছি!
লোকটি হাঁ করে বসে রইল।
৭.
সুফিয়া কামাল কাজী নজরুল ইসলামকে ডাকতেন দাদু বলে। কবি আবার প্রায়ই সুফিয়া কামালের বাড়ি যেতেন। সেখানে গানের আসর বসত। সে আসরে সাহিত্য অনুরাগী অনেকেই থাকতেন। এ সময় নজরুলের পেছনে গোয়েন্দা লাগে। সাহিত্যানুরাগীদের সাথে মিশে কয়েকজন গোয়েন্দাও আসতেন। একদিন এক ভদ্রলোকের মুখের ওপর নজরুল কবিতা আওড়ালেন-
তুমি টিকটিকি জানি ঠিকঠিকই।
কবিতার ধরন শুনে লোকটি মুখলাল করে উঠে যেতেই কিশোরী সুফিয়া কামাল অবাক হয়ে বললেন, দাদু। তুমি একে চিনলে কী করে?
গায়ের গন্ধে। বড়কুটুম যে! নজরুলের উত্তর।
৮.
কাজী নজরুল ইসলাম একবার ট্রেনে যাচ্ছিলেন। পাশে সমবয়সী লোক হঠাৎ তার উদ্দেশে বললেন, এই শালা, তোর কাছে দেশলাই আছে?
অপরিচিত একলোকের এমন সম্ভাষণে কবি প্রথমে চমকে উঠলেন, তারপর বিরক্ত। কিন্তু পরক্ষণেই পরিস্থিতি সামলে নিয়ে হেসে পকেট থেকে দেশলাইয়ের বাক্সটা তার মুখের ওপর ছুড়ে দিয়ে বললেন, লে বে শালা।
ইটের বদলে পাটকেল খেয়ে অপরিচিত লোকটি হো হো করে হেসে উঠে বললেন, পরিচয়ের একটু পরই আমরা এই সম্ভাষণেই পৌঁছাতাম। তাই অনেক ভেবে ওখান থেকেই শুরু করেছি। কী, ঠিক করিনি?
৯.
কাজী নজরুল তখন গ্রামোফোন কো¤পানির সাথে যুক্ত। এক দিন তিনি ওখানে দোতলায় বসে আছেন। এমন সময় এক কমর্চারী এসে বললেন, কাজী দা, ইন্দুদি (সঙ্গীতশিল্পী ইন্দুবালা) আপনাকে নিচে ডাকছেন।
এ কথা শুনে কবি সকৌতুকে বললেন, আর কত নিচে নামব, ভাই?
১০.
নজরুলের গানের জলসায় পান থাকবে না, তা হয় না। পান আর গান এ যেন একে অপরের পরিপূরক। এক দিন আসরে বসে গানের ফাঁকে চা-মুড়ি পর্ব সেরে নজরুল পান মুখে দিতে যাবেন, এমন সময় এক ছোট্ট মেয়ে এসে মিষ্টি হেসে বলল, তুমি এত পান খাও কেন?
নজরুল তার কথায় হো হো করে হেসে উঠে ততধিক মিষ্টিস্বরে বললেন, গান গাই যে!
১১.
কবি নজরুল তখন থাকেন কৃষ্ণনগরে। তার বন্ধু মঈনুদ্দীন থাকেন বেচু ঠাকুরের গলিতে কারমাইকেল কলেজের হোস্টেলের পেছনে। তিনি একদিন দাওয়াত করলেন কবি নজরুলকে।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কবি বন্ধু মঈনুদ্দীনের বাসায় আয়োজন। খুব আহামরি কিছু নয়, তবে অন্যদিনের চেয়ে ভালো। নজরুল এলেন। সোজা ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলেন মঈনুদ্দীনের ঘর।
কবি জিজ্ঞেস করলেন, এটি কিরে?
বন্ধুর উত্তর- রান্নাঘর।
-আর ওটা?
-ওটা হলো পায়খানা।
কবি বলে উঠলেন, দূর শয়তান! পায়খানা কিরে? বল ‘যায়খানা’। খানা তো ওখান দিয়েই যায়রে!
এটুকু বলেই হাসি। সে কী বিরাট প্রাণখোলা হাসি কবির। তার হাসির আওয়াজে জানালার কার্ণিশের আড়ালে বসে থাকা কবুতর পাখা মেলে ঝটপট করে উড়ে গেল।
১২.
পান জর্দা মুখে দিয়ে বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে গা এলিয়ে শুয়ে আছেন কবি নজরুল। এমন সময় এক লোক এলো কবিকে সালাম করতে। দরজায় দাঁড়িয়ে সে বেশ জোরে আসসালামু আলাইকুম বলল। কবিতার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘আরে, দুর্গাদাস বাবুর মুখে আসসালামু আলাইকুম যে!’
উপস্থিত সবাই কবির এমন আজব কথা শুনে আগন্তুকের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখে,
লোকটি সত্যিই বাংলা নাট্যমঞ্চের বিখ্যাত নট দুর্গাদাসের মতো সুদর্শন। আগত লোকটি বিনীতভাবে বললেন, আমি বন্দোপাধ্যায় নই, সৈয়দ। এই তো রায়পুরায় আমার বাড়ি।
একজন অচেনা মানুষকে এমন ভড়কে দিতে কবির আকস্মিক মন্তব্যে আবার হো হো করে হেসে গড়াল ঘরসুদ্ধ সব মানুষ।

বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের এমনি অনেক হাস্যরস বা রসবোধ বিভিন্ন গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এসব রসবোধ থেকে কবির মিশুক ও দিলখোলা মনের পরিচয় পাওয়া যায়।


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তি, এদের রুখতে হবে : ওবায়দুল কাদের সাদিক এগ্রোর ব্রাহামা জাতের গরু দেখলেন প্রধানমন্ত্রী ভারতে লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ সারা বিশ্ব আজ জুলুমবাজদের নির্যাতনের শিকার : ডা. শফিকুর রহমান মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও বোয়ালখালীতে ৩ জনের মৃত্যু গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল শ্যালকের অপকর্মে দুঃখ প্রকাশ করলেন প্রতিমন্ত্রী পলক রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

সকল