১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
কাজী নজরুল ইসলাম

‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ’

জন্ম : ২৫ মে ১৮৯৯, মৃত্যু : ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ -

বিশ্ব সাহিত্যের অসাধারণ প্রতিভাবান কবিদের একজন কাজী নজরুল ইসলাম। কবিতা, ছড়া,গল্প, গান, নাটক ও প্রবন্ধসহ সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে ছিল তার অবাধ বিচরণ। অর্থাৎ তিনি ছিলেন সব্যসাচি লেখক ব্যক্তিত্ব। কবিতার ক্ষেত্রে নানা বৈচিত্র্যের অধিকারী। তিনি যেমন বিদ্রোহীর মতো অগ্নি বিদ্রোহের শাশ্বত কবিতা রচনা করেছেন, তেমনই প্রেমের কবিতার ক্ষেত্রেও ছিলেন অনন্য। তার কবিতায় আন্তর্জাতিকতা, দেশ, সমাজের বিষয় যেমন উঠে এসেছে তেমনই যাপিত জীবনের প্রেম বিরহের বিষয়ও অত্যন্ত প্রাণঞ্জল হয়ে ফুটে উঠেছে। তবে তিনি প্রকৃত অর্থেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে শানিত শব্দের ঝঙ্কারে প্রমাণ করেছেন তিনি কবিতার ক্ষেত্রে বিদ্রোহের মহানায়ক। এ কারণেই তিনি বিশ্ব কবিতার ক্ষেত্রে এক কালজয়ী কবি।
১৮৯৯ সালের ২৫ মে ১১ জৈষ্ঠ যে সময়টিতে কবির জন্ম তা ছিল ইংরেজ শাসনামল, পরাধিনতার-শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল ভারতবর্ষ। স্বাভাবিকভাবেই সে সময়টিতে ইংরেজদের অপশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ যেমন বাড়ছে তেমনই স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাও তীব্র হচ্ছে। সে সময়কে ধারণ করেই কবির বড় হয়ে ওঠা। নিতান্ত দরিদ্র পরিবারের পিতৃহীন সন্তান হিসেবে ছোট বয়সেই লেটোর দলে গান গেয়ে অর্থ উপার্জন করতে হয়েছে কবিকে। ফলে,কবিত্ব স্বভাবের স্ফূরণ ঘটতে থাকে গান রচনার মধ্য দিয়ে। যেহেতু নজরুলের সামাজিক পারিপার্শ্বিক অবস্থান ছিল দরিদ্রবেষ্টিত, বঞ্চিত, নিপীড়িতদের কাতারে সে কারণে তার চিন্তা-চেতনায় বতি অসহায় মানুষের প্রতি তীব্র মমত্ববোধ তাকে এ বিষয়ক কাব্য রচনার ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে।
কাব্য শিল্প স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রেম-বিরহের মধ্যে ছিল সীমাবদ্ধ, তিনি তার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে সামাজিক অবক্ষয়, নির্যাতন, নিপীড়ন দ্বারা নির্যাতিত অসহায় মানুষের পক্ষাবলম্বনসহ অন্যায়ের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। এরই একপর্যায়ে ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের এক রাতে তিনি রচনা করেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রতিবাদী কবিতা বিদ্রোহী। এ কবিতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কলকাতায় কবির কক্ষসহচর প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা মোজফফর আহমেদ বলেন, রাত দশটার পর আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে বসেছি,এমন সময় নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে আমায় পড়ে শোনাল। বিদ্রোহী কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।
কবিতাটি প্রথমে ১৪২/১৪৩ পঙ্ক্তির হলেও বাংলা একাডেমীর নজরুল রচনাবলির (১৯৯৬) পাঠে অবশেষে তা দাঁড়িয়েছে ১৩৯ পঙ্ক্তি। বিদ্রোহী ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি প্রথম ছাপা হয় বিজলী পত্রিকায়। পত্রিকাটি প্রকাশিত হওয়ার পর এই কবিতার জন্য আরো দুবার মুদ্রিত হয়, যার সংখ্যা ছিল ২৯০০০ কপি। মোজাফফর আহমেদ আরো বলেছেন যে, ওইদিন কবিতাটি কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ পড়েছিল যার রেকর্ড অদ্যাবধি ভাঙেনি। পরে মোসলেম ভারত, প্রবাসীসহ আরো অনেক পত্রিকায় এ কবিতা ছাপা হয়েছে। এই কবিতাই তাকে বিদ্রোহী কবির খ্যাতি এনে দেয়।
তার এই কবিতায় তিনি ‘আমি’ এর মাধ্যমে নিজ মহিমায় আবির্ভূত হন। এ কবিতার ১০১টি পঙ্ক্তির শুরুতে আমি শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আর ভেতরে করেছেন ৪৭ বার। অথচ এতে কবিতার আধুনিকতা একটুও ক্ষুণœ হয়নি। বরং এই আমি ব্যবহার ছিল অনিবার্য।
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার আরেকটি বড় দিক হচ্ছে তিনি মরমীয়া ধারাতেও বেশ সপ্রতিভ ছিলেন। যেমন- আমি শ্রান্ত হয়ে আসব যখন/পড়ব দোরে টলে/আমার লুটিয়ে পড়া দেহ তখন,/ধরবে কি ঐ কোলে ?
তিনি ঈশ্বর কবিতায় বলেছেন, কে তুমি খুঁজিছ জগদীশে ভাই আকাশ পাতাল জুড়ে/কে তুমি ফিরিছ বনে জঙ্গলে,কে তুমি পাহাড় চুড়ে ?/ হায় ! ঋষি দরবেশ/বুকের মণিকে বুকে ধরে তুমি খোঁজ দেশে দেশে।/...
শিহরি উঠো না শাস্ত্রবিদেরে করোনাক বীর,ভয়-/
তাহারা খোদার খোদ প্রাইভেট সেক্রেটারি তো নয়!/সকলের মাঝে প্রকাশ তাহার সকলের মাঝে তিনি!/আমাকে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি/ কি চমৎকারভাবে তিনি অর্থবহ এই পঙ্ক্তির মাধ্যমে মানব সত্তার সাথে সৃষ্টিকর্তার তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ককে তুলে ধরেছেন।
একইভাবে তিনি যখন বলেন, আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন/ খুঁজি তারে আমি আপনায়,/
আমি শুনি যে তার সুরের ধ্বনি/আমারি তিয়াসী বাসনায়।/,আমারই মনের তৃষিত আকাশে / কাঁদে
সে চাতক আকুল পিয়াসে/কভু সে চকোর সুধা চোর আসে/ নিশীথে স্বপনে জোছনায়।
এখানে কবি মানব মনের সেই আকুতিকেই তুলে এনেছেন, লালন ফকিরও অচিন পাখির খোঁজে ব্যস্ত ছিলেন। এই যে মরমীয়া চেতনা তা সচেতন সৃজনশীল মানুষ মাত্রই ভাবে।
কবি তার কবিতার মাধ্যমে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন, মসজিদেরও পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই, সকাল-বিকেল আজান আমি শুনতে যেনো পাই। আল্লাহ তার সেই প্রার্থনা পূরণ করেছেন।
তিনি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনধারাকে গভীরভাবে অবলোকন করতেন বলেই খুব সহজেই সেই মানুষদের যাপিত জীবনকে তুলে আনতে পেরেছেন। ঈদ মানেই আনন্দ উচ্ছ্বাস। কিন্তু সেখানেও ব্যতিক্রম আছে। তিনি সমাজ বৈষম্যের এই চিত্র তুলে এনেছেন এভাবেই- জীবন যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/ মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?
তিনি ধনী দরিদ্রের পার্থক্যকে স্পষ্ট তুলে ধরেছেন। তিনি চেয়েছিলেন এক বৈষম্যহীন সমাজ। এক মানবিক সমাজ।
এ কবিতায় কবি আকাশ সম দৃঢ়তায় উচ্চারণ করেছেন-
আমি বেদুঈন,আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।
আমি বজ্র,আমি ঈশান- বিষানে ওঙ্কার
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার,
আমি পিণাক-পাণির ডমরু- ত্রিশূল,ধর্মরাজের দণ্ড
আমি চক্র ও মহাশঙ্খ,আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড।!
নজরুল ইসলাম শুধু বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ প্রতিভা নন, বিশ্ব সাহিত্যেরও রতœ তিনি। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর তিনি।
তার কুলি- মজুর কবিতায় তিনি বলেছেন- দেখিনু সেদিন রেলে/ কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে-/চোখ ফেটে এল জল/এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল!/... বেতন দিয়াছ ?- চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!/ কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোড় পেলি বল ?...বলো তো এসব কাহাদের দান ? তোমার অট্টালিকা/ কার খুনে রাঙা?- ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা।
নজরুলের এই প্রশ্ন ও সমাজ বিশ্লেষণ শাশ্বত। যতদিন পৃথিবীতে পুঁজির প্রভাব আর ধনী দরিদ্রের বৈষম্য থাকবে ততদিন তার কবিতার আবেদন থাকবে। পোশাক শিল্পখাতে আজ তো এটাই হচ্ছে। অনেক মালিক শ্রমিকের বেতন পরিশোধ না করলেও কোটি কোটি টাকার ইমারত গড়ছেন।
এখনো নজরুলের কবিতা নিয়ে মূর্খরা প্রশ্ন তোলেন আধুনিকতা নিয়ে। আধুনিকতা হচ্ছে সমাজ দর্পণ, যার মাধ্যমে মানব সমাজের প্রতি ক্ষেত্রের চিত্র উঠে আসে। নজরুলের মতো এত গভীর অনুভূতি নিয়ে কে এমন দেখেছে ?
এ কথা কবি নিজেই লিখেছেন তার কৈফিয়ত কবিতায়- কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু,আমিই কি বুঝি তার কিছু?/ হাত উঁচু আর হল না ভাই, তাই লিখে করি ঘাড় নিচু।...বড় কথা বড় ভাব আসে নাক’ মাথায়,বন্ধু,বড় দুখে।/ অমর কাব্য তোমরা লিখিও,বন্ধু যাহারা আছ সুখে।/...প্রার্থনা করো- যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস/ যেন লেখা হয় আমার রক্ত- লেখায় তাদের সর্বনাশ।
পৃথিবীতে দু’টিই জাত দু’টিই শ্রেণী। শোষক ও শোষিত। তিনি ছিলেন শোষিতের দলে এবং এজন্যই তার কবিতার পরতে পরতে দেখা যায় প্রতিবাদ ও দ্রোহের সুর।
আবারো বলছি কবি নজরুল বিশ্বের সকল মানুষের কবি। কারণ বিশ্বের সর্বত্রই এখনো সমাজ ব্যবস্থায় স্বৈরাচার, শোষক ও শোষিত মানুষের অবস্থান রয়েছে। তার কবিতার মূল সুরই হচ্ছে অন্যয়ের প্রতিবাদি সুর।
বিদ্রোহী কবিতাতেই তিনি উচ্চারণ করেছেন, মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেইদিন হব শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল,আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না’- বিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেইদিন হবো শান্ত!
উপলব্ধি করা যায়, কবি দুখী অসহায় অত্যাচারীতদের দলে। তার প্রত্যাশা ছিল অত্যাচারমুক্ত এক সুন্দর সমাজ- যেখানে আর প্রতিবাদের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু এখনো এ পৃথিবীতে অন্যায় অত্যাচার বিদ্যমান বলেই বিশ্বব্যাপী এ কবিতার আবেদন রয়ে গেছে।
তিনি জুলুমবাজদের বিরুদ্ধে এক সরব কণ্ঠস্বর। ফরিয়াদ কবিতায় তিনি জুলুমকারীদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন এভাবে-
তোমারে ঠেলিয়া তোমার আসনে বসিয়াছে আজ লোভী/ রসনা তাহার শ্যাম ধরায় করিছে সাহারা গোবী/ মাটির ঢিবিতে দু’দিন বসিয়া,/রাজা সেজে করে পেষণ করিয়া/এ পেষণে তারি আসন ধ্বসিয়া রচিছে গোরস্থান/ ভাই এর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে বীরের আখ্যা পান/ভগবান ভগবান।
কাজী নজরুল ইসলাম মানুষের কবি, মানবতার কবি। এ জন্যই তিনি লিখতে পেরেছেন মানুষ নামের মতো একটি কালজয়ী কবিতা।
গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান/,নাই দেশকাল পাত্রের ভেদ,অভেদ ধর্ম জাতি/সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
...আশিটা বছর কেটে গেল,আমি ডাকিনি তোমায় প্রভু /তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি/
মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি/
তিনি ধর্মের অপব্যবহার নিয়ে এমন সাবলীল উচ্চারণ করেছেন। এ কবিতাটি প্রিয় সাড়ে চার লাখ বার আবৃত্তি হয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলাম শুধু অন্যায়ের প্রতিবাদীই ছিলেন না তিনি ছিলেন আপাদমস্তক ধর্মীয় ভেদাভেদহীন একজন অসাম্প্রদায়িক কবি এবং মানুষ।...গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বিধা ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম ক্রিশ্চান।
এ পঙ্ক্তির বিচারে এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে তিনি কাব্য অঙ্গনে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার পথিকৃত।
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। তিনি লেখার পরতে পরতে দেশপ্রেমের অগ্নিময় বাণী যেমন আমাদের উদ্বেলিত করে, তেমনই তার দ্রোহ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে অনুপ্রাণিত করে।এ জন্যই তিনি মানুষের কবি,মানবতার কবি,বিদ্রোহের কবি,অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।


আরো সংবাদ



premium cement