২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ছেঁড়া নেকলেস

ছেঁড়া নেকলেস -


ঢাকনাটা উঁচু করে দেখল হাঁড়িতে আর ভাত নেই! এবার আস্তে করে ঢেকে রেখে কাজে চলল গার্মেন্টশ্রমিক মিজান। ঝর্না পেছন থেকে ডেকে বলল, ‘ও মা! খাবারটা না নিয়ে কোথায় চললে?’
আজ আমার পেটটা ভালো নেই। তোমাকে তো বলা হয়নি। রাতে বেশ কয়েকবার আমাকে বাথরুমে যেতে হয়েছে। আচ্ছা ঠিক আছে খাবার না নাও তাহলে ধরো নেকলেসটা নিয়ে যাও। এটি বিক্রি করে আপাতত সমস্যাগুলো সমাধান করো। পরে না হয় আবার বানিয়ে দিয়ো।
কথাটা শুনেই চোখগুলো ছলছল করছিল মিজানের। এই সেই নেকলেস, যেটি তিল তিল করে পরিশ্রমের টাকা গুছিয়ে বানিয়েছিল ঝর্নার জন্য। বাবা-মাকে না জানিয়ে ভালোবেসে বিয়ে করেছে তারা। দুজনেই গার্মেন্টে চাকরি করত। এখন অবশ্য মা হতে চলেছে ঝর্না। তাই তো আপাতত চাকরি করছে না। টানাপড়েনের ছাপ পড়েছে তাদের সংসারে। উপায়ান্ত না পেয়েই আজ স্বামীর হাতে তুলে দিতে চাইছে ভালোবাসার শেষ চিহ্নটুকু। এর আগেও অনেকবার তুলে দিতে চেয়েছিল, সেটা তো ছেঁড়া নেকলেসটা জোড়া লাগানোর জন্য। কিন্তু আজ সে দিতে চাইছে বিক্রি করে সংসারটাকে জোড়া লাগানোর জন্য। যেটা মানতেই পারছে না মিজান। অবশেষে ওদিকে হাত না বাড়িয়ে গন্তব্যর দিকে পা বাড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, দরজাটা লাগিয়ে দিয়ো।

গত রাতেও ভালো লাগছে না বলে না খেয়ে শুয়ে পড়েছিল সে। কাজ থেকে ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা বেজেছিল। আজও না খেয়ে চলেছে। তিন মাস ধরে বেতন নেই! ঘরে চাল নেই, তরিতরকারি তো দূরের কথা! এর মধ্যেই আবার বিল পরিশোধ করতে না পারায় ডিস লাইনটা পর্যন্ত কেটে দিয়েছে অফিস থেকে। ওদিকে ভাড়া না দিলে বাসা ছেড়ে দিতে বলেছে বাড়িওয়ালা। ঝর্নাও কথা দিয়েছে, কাল আমরা টাকা পরিশোধ করতে না পারলে বাসা ছেড়ে দেবো। আর এসব শুনেই হয়তো এমন সব কাণ্ড করে চলেছে মিজান। তারপরও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ঝর্না আবারো বলল, ‘বাসা ভাড়াটার কথা যেন মনে থাকে। আজ কিন্তু লাগবে...।’
মিজান-ঝর্নাদের সংসারগুলো এভাবেই অর্থের অভাবে পেটের সাথে, মালিকের সাথে, পরিবারের সাথে এমনকি সমাজের সাথে প্রতিনিয়তই বরফযুদ্ধ চলে। যে যুদ্ধ শহরের অট্টালিকা, গাড়ি আর বাবু-মেমদের কাছে বারবার পরাজিত হয়।
যাই হোক আজ আর কাজে মন বসছে না মিজানের। খবর নিয়েছে আজকেও বেতন হবে না। তাই তো ম্যানেজারের কাছে গিয়ে খুব কাকুতি-মিনতি করল। যেভাবেই হোক একটা ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। ইতোমধ্যেই আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে শ্রমিকরা। অবশ্য এসবে নিজেকে মোটেই জড়াতে চায় না মিজান। কোনোরকম জীবনযাপন করতে চায় সে। কিন্তু মনে পড়ল ঝর্নার সেই কথাটি। ‘আজ বাসা ভাড়া দিতে হবে। আর না হলে বাসাটা ছেড়ে দেবে বলে বাড়িওয়ালাকে কথা দিয়েছে ঝর্না।’
ঝর্না আবার এক কথার মেয়ে। যা বলে সেটিই করে ছাড়ে। বাবা-মা হারা মেয়েটা মিজানের কাছেই খুঁজে পেয়েছে অফুরন্ত শান্তি। তাই তো আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করে। তবে ওর মনে বড় আশা আছে, শ্বশুর-শাশুড়ি যদি তাকে মেয়ের মতো আশ্রয় দিত। বাবা-মায়ের মতো যদি খেদমত করতে পারত। তাহলে মনটা শান্তি পেত। তারপরও তাদের জন্য প্রাণভরে সবসময় দোয়া করে ঝর্না। খোঁজ খবর রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু আপাতত আর্থিক কারণে সেটিও পারছে না। তবে মিজান সব সময় সান্ত্বনা দেয়, মন খারাপ করে না লক্ষ্মী। একদিন দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে...।

হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কবে এবং কিভাবে? সেটি জানা নেই। এদিকে এ মাসের শেষের দিকে তাদের ঘরে সন্তান আসবে। এর জন্য ঝর্নার নিয়মিত খাবারের পাশাপাশি কিছু পুষ্টিকর খাবার খুব জরুরি। কিন্তু ঘরে তো চাল-ডালই নেই। আর পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা। তাই তো সকালে ছেঁড়া নেকলেসটা বিক্রি করতে বলেছিল ঝর্না। অবশ্য এই নেকলেসটা হাতে পাওয়ার পর ঝর্না একদিন মিজানকে কথা দিয়েছিল, যেভাবেই হোক এটি তার সাথে রাখবে। আর আজ বিক্রি করতে বলছে। এর জন্য তো দায়ী সংসারের দুরবস্থা! তাই নিজেকে বড় অসহায় এবং অপরাধী মনে হচ্ছে। কথাটি মনে পড়ার পর তার বুকটা দুমড়ে-মুচড়ে দুই চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।
এদিকে বাইরে শ্রমিকদের প্রচুর মিছিল শুরু হলো। বেতন চাই-বেতন চাই, ভাত খেয়ে বাঁচতে চাই। কথাগুলো শুনে মিজানও আজ উত্তেজিত হয়ে উঠল। শরীরের লোমকূপ শিউরে উঠল। দানবের মতো নিচে নামল। কতগুলো কাঁক গগনচেরা সাইরেন বাজিয়ে কা কা করতে করতে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। মিজানের চোখে এখন শুধু ঝর্না, আগত সন্তান আর ছেঁড়া নেকলেসটা বাঁচানোর স্বপ্ন। তাই তো মিছিলের সামনে গিয়ে হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিতে শুরু করলেন। চার দিকে চরম উত্তেজনা। ঠিক তখনি শুরু হলো গার্মেন্টের সিকিউরিটি কর্তৃক লাঠিচার্জ, ধস্তাধস্তি আর চিৎকার!

বিকেলে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলো ঝর্নার মোবাইলে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে বলা হলো। রিকশাযোগে খুব কষ্টে হাজির হলো ঝর্না। জানা গেল, লাঠিচার্জের সময় মাথায় জখম হয় মিজানের। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় এবং হাসপাতালে আনার পর জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। হঠাৎ দুজন গার্মেন্টের পূর্বপরিচিত মেয়ে এসে ঝর্নাকে ধরে কান্না শুরু করল। ঝর্না জিজ্ঞাসা করল, ‘কীরে তোরা কাঁদছিস কেন? মিজান কোথায়?’
কান্নার ভেতর একজন বলল, ‘মিজান ভাই আর নেই! তাই লাশটাকে বুঝে নেয়ার জন্য তোমাকে অভিভাবক হিসেবে ডাকা হয়েছে ভাবী।’ ঘটনা শোনার পর ঝর্নার চিৎকারে হয়তো কেঁপে উঠল পুরো শহরের আকাশ-বাতাস। তবে কাঁপল না কোন বাবু-মেমদের মন।
অবশেষে লাশবাহি গাড়ি ডাকা হলো। কারণ ঝর্না মিজানের লাশটা অন্তত ওর বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে স্বামীর ভিটাতে বাকি জীবনটা প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। নববধূ সেজে যদিও শ্বশুরবাড়ি কখনো যেতে পারেনি ঝর্না। তবে আজ বিধবা সেজেই যাবে স্বামীর বাড়িতে। সাথে থাকবে স্বামীর লাশ। কিন্তু এতেও তো অনেক টাকার দরকার। ড্রাইভারও বুঝতে পারল এদের টাকা দেয়ার সামর্থ্য নেই। তাই যেতে রাজি হলো না। শেষ পর্যন্ত ঝর্না সেই শেষ সম্বল ছেঁড়া নেকলেসটা ড্রাইভারের হাতে গুঁজে দিয়ে দু’হাত জড়িয়ে ধরে বলল, এটা রাখুন। এটা ছাড়া আমার কাছে আর কিছুই নেই। তবুও আমার স্বামীর লাশটা নিয়ে একটু আমাদের গাঁয়ের বাড়িতে চলুন। দয়া করে নিষেধ করবেন না, এই শহরটার কাছে আমি আর কোনোদিন কিছু চাইতে আসব না। কারো কাছে কিছু চাইব না। এটাই শেষ চাওয়া... বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল! আর তার এই কান্নার সাথে আরো কাঁদছিল গার্মেন্টের অজস্র শ্রমিক!’
রাত নেমে এলো। গাড়ি চলতে শুরু করল। ঝর্নার সম্মতিতেই মালিক ওদের বাসায় সব জিনিসসহ তালা ঝুলিয়ে দিলো। এখন শুধু স্বামীর লাশের পাশে বসে ঝর্না ভাবছে- তাদের আগত সন্তানটার কথা আর সামনের দিনগুলোর কথা...।’

 


আরো সংবাদ



premium cement