২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বাংলা নববর্ষ ও বাংলা কবিতাবিষয়ক সহজ পাঠ

-

বাংলা নববর্ষ বিষয়ের সহজপাঠ :
বাংলা নববর্ষের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে আমাদের। অন্য দেশের জনগণেরও আছে ভাষার প্রতি সনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও এ বিষয়ের ওপর মোহ ও জ্ঞানের তাৎপর্যময় আগ্রহ। বাংলা নববর্ষ নিয়ে আলোচনা করার আগেই আমাদের বাংলা সন সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেয়া জরুরি।
প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ প্রাপ্তিরও বহু পূর্বে বাংলা সন প্রচলিত হয়েছে। দিল্লির সম্রাট আকবর এই বাংলা সনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করেন। এর পেছনে তার উদ্দেশ্য ছিল মূলত প্রজাদের কাছ থেকে খাজনাপাতি ও রাজস্ব আদায়োর জন্য সুষম নিয়মনীতির প্রয়োজন।
আমরা জানি পূর্র্বে এই ভারতবর্ষে যখন ইরান তুরান পারস্য থেকে মুসলিম শাসকরা দেশ জয়ের ইচ্ছা নিয়ে এখানে আক্রমণ করতেন এবং সিংহাসন পাকাপোক্ত করে বসতেন তখন মূলত হিজরি সনকে তারা বছরের দিনলিপি হিসেবে গণনা করতেন। কিন্তু লক্ষ করা গেল যে, আকবরের রাজ্যে একবার তীব্র পানি সঙ্কট দেখা দেয় এবং এই কারণে দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণের শস্য উৎপাদিত হলো না। যার ফলে রাজস্ব আদায় ও খাজনা প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
হিজরি সনের বিষয়টি চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর ছিল তাই খাজনাপাতি ও বাংলা হিসেবে মাস গণনায় বছরের প্রায় ১১-১২ দিন এদিক-সেদিক হয়ে যেত। যার ফলে মানুষের পক্ষে খাজনার হিসাব নিয়ে বেশ বিড়ম্বনা তৈরি হতো। এই সমস্যা নিরসনে তাই সম্রাট আকবর তার মন্ত্রিসভার ০৯ জন মন্ত্রীকে নিয়ে ‘দেওয়ানি খাসে’ বসে জরুরি বৈঠক করেন এবং তার গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ সিরাজীকে বাংলা সন চালু করার দায়িত্ব অর্পণ করেন। ফতেউল্লাহ সিরাজী ১৫৫৬ সনের ১৪ ফেব্রুয়ারি সৌরসাল বা সূর্য ওঠার সাথে দিনের হিসাব মিলিয়ে বাংলা সনকে যুক্ত করেন যা সম্রাট আকবর ১৫৮৪ সালে ‘দেওয়ানি আমে’ বসে জনগণের সামনে ঘোষণা করেন। মূলত তখন থেকেই বাংলা সনের প্রচলন।
তবে এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক যে যেহেতু তখনকার ভারতবর্ষে হিজরি সাল প্রচলিত ছিল তাই ৯৬৩ সালে ১ মহররমকে হিসাবের মধ্যে গ্রহণ করেই বাংলা সনের প্রথম দিবস চালু করা হয়। ফলে সহজেই বলা যায় যে বাংলা সনের ৯৬৩ সংখ্যাটি বাংলার সাথেই মিলিত হয়ে পরবর্তীকালে বাংলা সন আমাদের ইতিহাস ও কৃষ্টিতে বিচরণ করে।

বাংলা সন চালু হলেও প্রশ্ন থেকে যায় যে এর বারো মাসের নাম কিভাবে এলো। তাও ফতেহউল্লাহ সিরাজী নির্ধারণ করে দেন। তিনি বারোটি নক্ষত্রের নামের সাথে নাম মিলিয়ে বাংলা বারো মাসের নাম সংযুক্ত করেন। যেমন : বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জৈষ্ঠ্য, উত্তরাষাড়া থেকে আষাঢ়, শ্রাবণা থেকে শ্রাবণ, পূর্বভাদ্রপাত থেকে ভাদ্র, আশি^না থেকে আশি^ন, কৃত্তিকা থেকে কার্ত্তিক, মৃগাশিরা থেকে অগ্রহায়ণ, পুস্যা থেকে পোষ, মঘা থেকে মাঘ, উত্তরা ফাল্গুন থেকে ফাল্গুন এবং চিত্র থেকে চৈত্র উল্লেখ করা হয়। এভাবেই বাংলা সনে বারো মাসের নাম লিপিবদ্ধ হয়।
এবার আসা যাক বাংলা সনের ওপর নববর্ষ নিয়ে সহজ কিছু কথন
বাংলা নববর্ষের প্রথম তথ্যটি আসলে সম্রাট আকবরের আমল থেকেই পাওয়া যায়। তখন কৃষকরা ধান কাটার সাথে সাথে খাজনাপাতি প্রদান করে নিজেদের ভেতর একপ্রকার প্রশান্তি অনুভব করতেন এবং সেই উল্লাসে পাড়ায় পাড়ায় গ্রামে গ্রামে নিজেদের সাধ্যমতো আনন্দ ভাগ করতেন যা নববর্ষ পালনের একটি প্রাথমিক পর্যায়।
সেভাবেই সময়ের হাতল ধরে বাংলাদেশেও এটি পালিত হয় মহা আনন্দের সাথেই। তবে বাংলাদেশেও যে এর একটি ইতিহাস রয়েছে তাও জানা প্রয়োজন। বাংলাদেশে প্রথমই ১৯৬১ সালে এই দিনটিকে পালন করার জন্য সুফিয়া কামাল, সানজিদা খাতুন, ফরিদা হাসান, মহিদুল হাসানের মতো প্রমুখ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ ‘ছায়ানট’ নামের একটি সংগঠন করে বর্ষবরণ উদযাপনের জন্য রমনার বটমূলে বাংলা ভাষার গান নাচ কবিতা আবৃত্তি ও কীর্তনের ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে বাঙালির মন-মননে বাংলা নববর্ষের এক আলাদা রূপসত্তা তৈরি হতে থাকে।
তারপর ১৯৬৬ সালে মো: শহিদুল্লহার নেতৃত্বে এবং ১৯৮৭ সালে এই বাংলা বর্ষের দিনপঞ্জিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়। তখন থেকেই বাংলাদেশ প্রকৃতভাবে বাংলা দিনপঞ্জি ও বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটিকে উদযাপনে আরো প্রাণিত হই। শুরু হয় রাজধানীতে মঙ্গল শোভাযাত্রা, র্যালিসহ জেলায় জেলায় আনন্দ উৎসবের বাঁধভাঙ্গা মিছিল।

যদিও তার পূর্বেই ১৯৮৬ সালে যশোরে চারুপীট নামের একটি সংগঠন হিরন্ময় চন্দ্র ও মাহবুব জামালের সক্রিয়তায় আনন্দ মিছিল হয় যাতে অনেকেই যোগ দেয়। পরবর্তী সময় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা সেই অনুসারে মানুষের প্রতিকৃতি, কুমির, বাঘ, পেঁচা, হাতি, বাদ্যযন্ত্র ও মুখোশ নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে যার মূল স্লোগানে ছিল অশান্তি ও সব অকল্যাণের বিরুদ্ধে সমবেত হওয়া।
বাংলা নববর্ষ উদযাপন এখন আর রাজধানীভিত্তিক নয়। এখন এই আনন্দ বাঙালির হৃদয়ে স্থান করে ফেলেছে। ফলে প্রতিটি জেলায় শহরের তা বিস্তৃত। এখন এই নববর্ষের আনন্দ ঢাকার অদূরে সোনারগাঁয়ে চলে বউ মেলায়, চলে ঘোড়ার বহরে, চলে নাগরদোলা, পুতুল নাচ, হা-ডু-ডু, ফুটবল, ক্রিকেট ও কীর্তনসহ আরো গ্রামীণ কৃষ্টির আবহে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে তা এখন ‘বৈসাবি’ নামেও উল্লেখযোগ্য কৃষ্টির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাঙালির এই আনন্দে কিন্তু প্রথম পর্যায়ে ইলিশ বা পান্তা ভাতের প্রচলন ছিল না। এটি সাম্প্রতিককালের যুক্ত একটি আনন্দ। আরো রয়েছে নতুন পোশাক পরা, বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ করা, ঘরে ঘরে মিষ্টি পিঠাপুলি খইমুড়ি দ্বারা আপ্যায়নসহ সারারাত অনুষ্ঠানে মজে থাকা।
এই নববর্ষের আনন্দ ও মঙ্গল শোভাযাত্রাটি বাঙালিকে এতটাই উৎসাহিত ও উজ্জীবিত করে যে একটি এখন আর বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, তা এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে ওপার বাংলায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। আর সেসব সূত্রে বাংলা একাডেমি ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিগত ২০১৬ সালে ৩০ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘের আওতাধীন ইউনেস্কোর অধীনে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুমোদিত হয়।
এভাবেই বাংলা সন ও বাংলা নববর্ষ আমাদের কৃষ্টিতে স্থায়ীভাবে মর্যাদায় আসীন হয়। যা থাকবেও চিরকাল।

বাংলা কবিতা উৎপত্তির সহজপাঠ
যারা সাহিত্য চর্চা করেন তারা প্রায় সবাই বাংলা কবিতার উৎপত্তি নিয়ে অবহিত। আর যারা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তাদের জন্য আমার এই প্রয়াস ধৃষ্টতা হবে, তবু ক্ষুদ্র পরিসরে সহজভাবে সবার জন্য বাংলা কবিতার উৎপত্তি নিয়ে আলোকপাত করছি।
বাংলা সাহিত্যের তিনটি কাল বা যুগ রয়েছে। প্রাচীন যুগ যা শুরু হয়েছে ৬৫০ থেকে ১২০০ পর্যন্ত।
মধ্যযুগ যা শুরু হয়েছে ১২০০ থেকে ১৮০০ পর্যন্ত এবং
আধুনিক যুগ ১৮০০ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত।
এই যে কাল পরিবর্তন বা কাল প্রবাহমান তার মধ্যেই হয়েছে আমাদের সাহিত্য সৃষ্টি ও গল্প প্রবন্ধ গান কবিতার চর্চা। যদিও অনেকে ১২০০ থেকে ১৩৫০ সালকে অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করেছেন যার সাথে ব্যক্তিগতভাবে আমি একমত নই। কারণ বিরুদ্ধচারকারীরা উল্লেখ করেছেন ওই সময় ইরান তুরান তুর্কি থেকে মুসলমান শাসকরা ভারতবর্ষ শাসন করে এখানকার সাহিত্য সংস্কৃতি সব ধ্বংস করে দিয়েছে। আমি তা মনে করি না। কারণ হিসেবে তারা বলেন মুসলমান শাসকরা হিন্দুস্থানে অবিরাম ধ্বংসযজ্ঞ, পরিবর্তন, সঙ্ঘাত, সংস্কার এবং ধর্ম প্রচারের কারণে অনেক স্বাভাবিক কাজকর্মকে ব্যাহত করেছেন। তাই সারা বছর মানুষ একটি আতঙ্কের মধ্যে থেকেছে। রাজ্যের অভ্যন্তরে মানুষের নিজস্ব ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিল না। ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্য আক্রমণ ও ব্যবসায় সফলতার লক্ষ্যে মূলত ভারতের অনেক ক্ষতি সাধন করেছে। তাদের ভয়েও ভারতের সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ ছিল। এসব অযাচিত দাঙ্গা-হাঙ্গামা যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে সাহিত্য চর্চা তেমন উৎকর্ষতায় উপনীত হয়নি।

আমি বলব তার পরও মুসলমান শাসকদের কারণেই কিন্তু এই দেশের অনেক হিন্দু তাদের জমিদারি পেয়েছেন, অনেক স্থানে বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন, হিন্দুদের পুজো অর্চনার অধিক সুযোগ হয়েছে এবং অনেক হিন্দুর ব্যবসার প্রসার, বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু একশ্রেণীর সমাজপতি ও সমাজবিজ্ঞানী মুসলমান শাসকদের দোষারোপ করে ইতিহাসকে কলংকিত করেছেন। প্রকৃত কথা হলো রাজ্য সংস্কারে ব্যস্ত সুলতানদের কারোই কোনো ধর্ম বিরুদ্ধাচারণের স্পৃহা ছিল না, তবে সংস্কারের প্রয়োজনে এবং রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার কারণে সব সময় পৃথিবীর সব দেশেই কিছু ভাঙ্গা-গড়ার দৃশ্য বিদ্যমান হয়। তাই এই সময়টাকে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা সঠিক নয়। ড. আহমদ শরীফ দেখিয়েছেন মধ্য যুগই বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণ যুগ।
বিশেষ করে মুসলমানদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবার কারণে এবং রাজ্যে বিবিধ উন্নতি ও সংস্কার কাজে নিয়োজিত হবার কারণে সে সময়কার সাহিত্য সংস্কৃতির সেবকরা নিজেদের ঘর পরিবার সমাজ নিয়েই বেশি মশগুল থাকতেন। তারপরও এই সময়ে বিভিন্নভাবে ভাওয়াল গীতি, খনার বচন, প্রাকৃতপৈঙ্গল, শূন্য পুরাণ, কলিমা জলাল, সেক শুভোদয়ারের মতো অনেক সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। তবে এগুলো হয়তো সময়ের তুলনায় অতটা জননন্দিত হয়নি ফলে ইতিহাসে অতোটা নিবিড়ভাবে আসন গাড়তে পারেনি। বিশেষ করে হিন্দু লেখক রামাই পণ্ডিত তার শূন্য পুরাণ কিছুটা ইতিহাসখ্যাত হয়েছে যাকে অমর্যাদা করার উপায় নেই। রামাই পণ্ডিতের ‘নিরুঞ্জনের রুষ্মা’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য স্থানে রয়েছে। রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্য রচিত ‘সেক শুভোদয়া’ গদ্যেপদ্যে লেখা উল্লেখযোগ্য চম্পুকাব্য।
যা বলছিলাম বাংলা সাহিত্যে তিন যুগের প্রথমটি হলো প্রাচীনকাল। আর এই প্রাচীনকালেই সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা কবিতা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক নেপালের রাজ্যশালা থেকে ১৯০৭ সালে আবিষ্কৃত প্রথম এবং ১৯১৬ সালে বঙ্গিয় সাহিত্য পরিষদের সাহায্যে প্রকাশিত ‘চর্যাপদ’ যা প্রথম কবিতা হিসেবে চিহ্নিত। এখানে মোট সাতচল্লিশটি গানকে চর্যাপদের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, যাতে মূলত বৌদ্ধধর্মের গূঢ় সাধনপ্রণালী ও দর্শনের বর্ণনা রয়েছে।
বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য রচিত এই চর্যাপদের যেসব পদাবলি রয়েছে তাতে সমাজের অনাচার প্রেম অসঙ্গতির বর্ণনা বিদ্যমান। এই চর্যাপদে রয়েছে চব্বিশজন পদকর্তার নাম। সবার নামের শেষেই পা যুক্ত রয়েছে। তারা হলেন লুই পা, কুক্কুরি পা, বিরুআ পা, গুগুরী পা, চাটিল পা, ভুসুক পা, কাহ্ন পা, কামলি পা, ডোমলি পা,শান্তি পা, মহিত্তা পা, বীনা পা, সরহ পা, সবর পা, আজদেব পা, ঢেন্টণ পা, দারিক পা, ভাদে পা, তাড়ক পা, কঙ্কণ পা, জধনন্দি পা, ধ্যাম পা, তন্ত্রী পা ও লাড়িডোম্বি পা প্রমুখ।

চর্যাপদের সবচেয়ে বেশি পদ আছে কাহ্ন পায়ের। তবে লুই পা-কে সাহিত্য বিশারদরা অধিক সম্মান দিয়ে থাকেন কারণ রচনায় যে উচ্চমার্গিয় বিষয় রয়েছে তাতে তাকে সম্মানিত করা হয়েছে বেশি। লুই পা’র একটি পয়ার উল্লেযোগ্য। তিনি বলেন :
কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল
দৃঢ় করিঅ মহাসুখ পরিমাণ
লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ।
অর্থাৎ : শ্রেষ্ঠ তরু হলো এই শরীর যার পাঁচটি ডাল রয়েছে। এখানে চঞ্চল চিত্ত রয়েছে যাতে কাল প্রবেশ করে। তবে চিত্তকে দৃঢ় করে মহাসুখ আনয়ন করা সম্ভব। লুই পা বলেন গুরুকে শুধিয়ে সেসব জেনে নাও।
এভাবে চর্যাপদে সাতচল্লিশটি পদ রয়েছে। তবে এর ভাষা ও উপমা খুবই কঠিন বলে সাহিত্য সৃষ্টি ও সাধারণ মানুষের ভেতর তা আশার সঞ্চার করতে পারেনি। চর্যাপদের ভাষাকে কেউ কেউ সন্ধ্যাভাষা বলেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী উল্লেখ করেন : চর্যাপদের ভাষা হলো কিছু আঁধারি কিছু আলো, যা খানিক বুঝা যায়, যা খানিক বুঝা যায় না। যারা সাধন-ভজন করেন তারাই চর্যাপদকে সহজে পাঠ করতে পারেন।
মানুষ সবসময়ই চায় সহজ সরল উক্তি বা ব্যাখ্যা। তাই প্রাচীনকালের চর্যাপদের প্রতি সংস্কৃতিকর্মীদের পরিচর্যা হ্রাস পায় এবং একসময় চর্যাপদের আবেদন কমতে কমতেই চলে আসে মধ্যযুগের সাহিত্য বিস্তারের নতুন আলো। এখানে দেখি বড়– চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্য। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমময় কাহিনী অবলম্বনে রচিত এই শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন বাংলা সাহিত্যর এক উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। মধ্যযুগের আরেক প্রথম মুসলিম কবি ছিলেন শাহ মুহাম্মদ সগীর। তিনি রচনা করেন ‘ইউসুফ জুলেখা’র প্রেমকাহিনী। এটিও বেশ উল্লেখযোগ্য। এভাবে মধ্যযুগে আরো কিছু কাব্য রচিত রয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে, যেমন : মহাভারত,মনসামঙ্গল, চণ্ডী মঙ্গল, শিব মঙ্গল, বৈষ্ণব পদাবলি, রামায়ণ। এগুলো প্রাচীন যুগের তুলনায় অনেক সহজ ও সুখপাঠ্য হিসেবে পরিচিত।

এ মধ্যযুগে এসে আমরা দেখি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ইংরেজি বা পাশ্চাত্যের প্রভাব ঢুকে পড়েছে। শিক্ষিত বাঙালিরা ইংরেজি সাহিত্যের রস আস্বাদনে মশগুল হয়ে পড়েন। ফলে বাংলা চর্চার পাশাপাশি ইংরেজি সাহিত্যে অনেক ভাব শব্দ উপমা ভিড় করে। তারা তখন পড়তে থাকেন ইলিয়ট, শেকসপিয়র, গ্যেটে, দান্তে, কিটস, বায়রন, বোদলেয়ার। আর এ মোক্ষম কাজটি করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলাকে পাশ্চাত্যের ভাবধারায় আরো গতিশীল ও আধুনিক করার প্রচেষ্টা চালালেও একসময় ফিরে আসেন নিজ আলয়ে। তিনি তখন আক্ষেপ করেই অমিত্রাক্ষর ছন্দে বলেন :
‘হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।’
মধুসূদনের পরপরই বাংলা কবিতা আরো কিছুটা সহজ করে দেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, বিহারিলাল প্রমুখ।
কিন্তু যে অসাধ্য কাজটি করেন তিনি হলেন আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অবিকশিত বাংলা ভাষাকে প্রাচীন ও মধ্যযুগের কঠিনতর অবস্থা থেকে মুক্তি দেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি সাহিত্যকে আরো উৎকর্ষ ভাষার শৈলীতে গৌরবময় করে তোলেন বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়, গল্পে, কবিতায়, প্রবন্ধে, গানে, উপন্যাসে ভরিয়ে দেন বাংলা ভাষার নান্দনিক পরিচয়।
মধ্যযুগের পৌরাণিক কাহিনীকে আরো স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যে রচনা করেন মুক্ত ছন্দে, অন্তমিলে এবং চিত্রকল্পের ভিন্ন এক দ্যোতনা-দোলায়। তিনি বাংলা কৃষ্টি ও সাহিত্যকে কবিতা-গল্পে অনুভব করে কতটা নিবিড়ভাবে দেখেন তা নিচের উক্তি থেকেই অনুধাবন করা যায়। তিনি বলেন :
নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছো নয়নে নয়নে
হৃদয় তোমারে পায় না জানাতে
হৃদয়ে রয়েছো গোপনে।
তবে রবীন্দ্রনাথের এই সহজ সরলীকরণ ব্যাখ্যাকেও একসময় পঞ্চপাণ্ডব কবিখ্যাত সুধীনন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী ও বিষ্ণু দে অস্বীকার করেন। তবে পরবর্তী সময় সাহিত্য সৃষ্টির এই সর্বজনগ্রাহ্য শ্রুতিময়তার প্রবক্তা রবীন্দ্রনাথকেই আজো শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে রাখা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কালের সাক্ষী হয়ে রইল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের পর আসেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাকে বলা হয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দ্বিতীয় স্রষ্টা। বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ণ নতুন এবং আলাদা জগৎ নির্মাণ করলেন তিনি।
(প্রবন্ধটি কবি ও সাংবাদিক শাহীন চৌধুরীকে উৎসর্গ করা হলো।)


আরো সংবাদ



premium cement

সকল