২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সৃজনশীল কাজের প্রভাব

-


আজকের সমাজের বিপুল মানুষ নিয়তিবাদী। নিয়তিতে বিশ্বাস আর নিয়তির বিশ্বাসে তলিয়ে যাওয়া এক কথা নয়। কথাটার মধ্যে বিস্তর দূরগামিতা রয়েছে। অধিকাংশ মানুষ একটা গতানুগতিক জীবনধারায় নিজেকে যুক্ত করে নিয়েছে। তাই তারা নিরব নিশ্চুপ এবং নিঃস্পৃহ। এই প্রক্রিয়া প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চাপিয়ে দিয়ে তার আগামীকেও ওই একই মানসিকতার মধ্যে আটকে ফেলেছে। ক্ষমতা এভাবেই তার নানা ফন্দির মধ্যে এই ফন্দিগুলোকে জীবন্ত করে রাখে নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে। তারা সংস্কৃতি বিভাগ চালু করে মূল থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে। বাস্তবে প্রতিটি মানুষই জন্মে একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে; কিন্তু সামাজিক বিশ্বাস, রীতি-রিস্তা মানব সন্তানটির উপর ক্রমেই চেপে বসতে থাকে তার পরিবার, সমাজ, শিক্ষালয় দ্বারা। এবং এই পর্ব থেকেই তার মানবিক সত্তা বিভাজিত হতে থাকে এবং একদল ভঙুর মানুষের উপস্থিতি ঘটায়। এভাবে একজন মানুষ হয়ে ওঠে যৌগসত্তার মানুষ। ফলে গণমানুষের বোধে সংস্কৃতির বিকাশমান ধারাটির বিকৃতরূপটিই আসল বলে গণ্য হয় এবং কবি শিল্পীরাও চক্রান্তমূলকভাবে সেগুলোকে উত্তম বলে গোঁফ দাড়ি চুল নাড়াতে থাকে। ক্যাফেতে ছবি টাঙিয়ে হাসতে থাকে। এই সমস্যা কেবল বাংলা কবিতায় তা সত্য নয়, বরং উন্নত দেশগুলোর নানা ভাষাভাষির সাহিত্য-কাব্য গোটা সংস্কৃতির জগৎ একই রকম মনস্তত্ত্ব দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। ভাঙার সুর যে কখনো বাজেনি বা বাজে না তা নয়; কিন্তু অন্ধত্ব এমনই এক জিনিস যাকে নাড়াতে হলে পুরো রাজনৈতিক জীবনকাঠামো যার উত্তরাধিকার এই বর্তমান- তাকেই সজোরে সরোষে ভাঙার ইচ্ছেটাকে প্রবল করতে হয়।


০২.
সৃষ্টিশীল কাজ একটু হেরফেরসহ আজও অবধি গতানুগতিক। একটি উপন্যাসে একজন নায়ক, একজন নায়িকা, একজন ভিলেন দু-চারটে পার্শ্বচরিত্র এই নিয়ে বিস্তার সেই কবে থেকে শুরু হয়েছে আজো তারই রমা। কারণ সমাজটার বদল প্রযুক্তির উপস্থিতিতে ঘটায় তার উল্টো ফলটা সর্বত্র পরিলক্ষিত। যদিও বেশি মানুষরাও এই প্রযুক্তির অধীন হয়ে নিত্যদিনের নামতা পড়ছে; কিন্তু রাজনৈতিক পরিবর্তন যা মানুষকে আধুনিক মানুষের সড়কে তুলে দিয়ে নতুন জীবন পাঠের চৈতন্য গড়ে তুলবার প্রায়ই অনুপস্থিত রয়ে গেছে। ফলে সংস্কৃতির রূপটি সেই সামন্তীয় চরিত্র থেকে আধুনিক সময়োপযোগী হয়ে উঠতে পারছে না। কথা সাহিত্য বা কাব্য বা শিল্পভাবনায় গতি দেয়ার নাম করে বিভিন্ন সময়ে কতগুলো উদ্ভট তত্ত্বের সমাবেশ ঘটেছে; কিন্তু তা-ও অতীতমুখী মনোলোভা ভাববাদিতার হাওয়ার দাপটে বিকশিত হতে পারেনি। লক্ষ করলে দেখা যায় যে রবীন্দ্রনাথের মন্ত্রসাহিত্য থেকে মোড় ঘুরবার দেহতত্ত্ব ভাববাদিতার গান কাব্য রসগল্প, প্রেম উপাখ্যান সবই মনরোগের নাচ, বোধ ভুলানো, জীবনবিমুখ সৃষ্টির তেলতেলে ব্যবস্থা। এর সুরও গতানুগতিক, একটু এদিক সেদিক করে ছড়িয়ে আছে জনপ্রিয়। একজন আধুনিক সৃষ্টিশীল মানুষ কী ‘এইসব দিনরাত্রির ভালগার’ নিয়ে মাতামাতি করবে? প্রত্যেক শিল্পীই যদি সমাজের অগ্রগামী মানুষ হয়, এবং যদি সে তার কালের প্রতিনিধিত্ব করছে প্রতীয়মান হয় এবং যদি সে পুরো সমাজ মানুষকে অভীষ্ট করে লেখে চেতনাকে নতুন করে জাগ্রতি দেয়ার জন্য এবং যদি সে এটা বিশ্বাস করে তার সৃষ্টি সময়কে প্রতিনিধিত্ব করবে এই কারণে; কারণ পাঠকের রুচি বদলে দেয়াও তার নৈতিক। একজন মহান শিল্পী তিনি যিনি তার সমস্ত সৃষ্টির কাজ জনগণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত করেন বিখ্যাত হওয়ার জন্য নয়, কেবল তার সামাজিক দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে, তা হলেই পাঠক গণমানুষ তার দুঃখ ও দুঃসময়কে চিনতে পারবে জাগ্রত হবে বোধ । আর যদি সৃষ্টিশীল ব্যক্তি নিজেকে নিয়োজিত করেন পা চাটবার জন্য, তা হলে সে সেই সব নোংরাকেই তুলে আনবেন স্বার্থপরায়ণতায় যা পুরনো, ক্যানক্যানে, সেই একই সুর একই ছন্দে যার কোনো বিরাম নেই। সৃষ্টিশীলকে অবশ্যই সমাজ সচেতন হতে হবে, সমাজের যে চাহিদা এখন বর্তমান তা মূলত মেকি, মানুষ চায় স্বাধীনতা, চায় মুক্তি এই কথাটা জোর দিয়ে প্রতিটি সংস্কৃতি কর্মীকে ঢোলের বাদ্যের মতো বাজাতে হবে।


পরকাল, মনোলোভা বেহেস্ত তুমির প্রিয়তাকে ঝেড়ে তুমিকে করতে হবে আকাক্সক্ষার প্রতীক। সুর ও ছন্দকে করতে হবে নব্য নন্দনতত্ত্বের ব্যাকরণ। লেখক শিল্পীরা জীবনযাপনে পরিচ্ছন্ন না হলে, ন্যায় ও ন্যায্যতায় নিজের উপলব্ধিকে শাণাতে না পারলে আধুনিক হয়ে ওঠা এবং গণ্ডি ভাঙা সত্যি অসম্ভব। মানুষের অপমানকে যে শিল্পী তার সৃষ্টির মাধ্যমে চিনিয়ে দিতে ব্যর্থ সে ব্যর্থ তার কালের প্রতিনিধিত্ব তৈরিতেও। চলমান বিশ্বরাজনৈতিক ব্যবস্থা মানুষকে গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলছে নির্মমভাবে। তার শিক্ষা উপযুক্ত পর্যায় আর অবশিষ্ট নেই, আধুনিকতার নামে তাকে মতলবী শিক্ষানীতি দ্বারা নব্যদাস্যবৃত্তির ফাঁদে আটকে দেয়া হচ্ছে। নিচের মানুষের সন্তানরা জ্ঞানে নয়, বরং নব্যদাসে পরিণত হয়ে রপ্তানী হবে নয়া দেশে বা স্বদেশে মানুষ ঠেঙানোর কাজটি পোক্ত করার জন্য কর্মকমিশন নামক এক আজব প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নির্দয় আমলা হবে। ফলে সৃষ্টিশীল মানুষ যে কেবল কবিতা গল্প উপন্যাস সঙ্গীত ভাস্কর্য ইত্যাদির মাধ্যমে নন্দনতত্ত্বের সনাতনী ব্যবস্থার উমেদারী করে না বরং তৈরি করতে হয় একটা সুষ্ঠু সবল সংস্কৃতির বোধ যা দিয়ে পাঠক যেমন নিজেকে চিনতে পারবে, চিনতে পারবে তার কাল তার সমাজ তার আত্মার স্বরূপ। কিন্তু শিক্ষাটাই যদি হয় প্রতারণামূলক, যদি তা হয় দাসত্বের এবং রাষ্ট্রমালিকদের ইচ্ছার তা হলে তার সৃষ্টিতে নতুন বোধবোধন উদ্বোধিত হয় না। একটি শক্তিশালী সংস্কৃতির প্রবাহ একটা ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী। মারণাস্ত্র দ্বারা কয়েক মুহূর্তে কয়েক লাখ লোককে এবং তাদের অস্তিত্বকে ধ্বংস করতে পারলেও সমাজে চলমান অভ্যেস, রুচি, চিন্তা, ব্যবহারিক বিষয় বদলাতে শত শত বছরের চেষ্টার দরকার হয়। দরকার হয় বিপ্লবের। মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী এই রাজনীতি পরিচ্ছন্ন না হলে সে যেমন বংশপরম্পরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি রাজনীতি গতিশীল হলেই শিল্প সাহিত্য কাব্য সংস্কৃতির কর্মকাণ্ডসহ জীবনও পরিশুদ্ধি পায়। এ রকম অবস্থায় কেবলমাত্র সমাজের প্রান্তিকজনরাই আটকে থাকে না, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তরাও এর অধিনস্ত হয়ে পড়ে। তবে তাতে পার্থক্য আছে। পার্থক্য হলো প্রান্তিকজনরা এর দ্বারা অধিকার বঞ্চিত হয়, অধিক হারায়, ফলে শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন, অপকীর্তি, দুর্নীতি কুকর্ম সবই উপরের কৃপা বলে চালিয়ে দিতে পারে। নতুন চিন্তার জন্মলাভ হয় না, পুরনো চিন্তাই খানিকটা এদিক সেদিক করে ঘুরপাক খায় যার কোনো বিচ্ছুরণ নেই, প্রভা নেই, নতুন কোনো দিশাও নেই। চিন্তার আবদ্ধতা এমন যে ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলোকে গুলিয়ে কতগুলো কুসংস্কারমূলক চিন্তাকে ধর্মের সাথে যুক্ত করে প্রধান করে তোলে যা ধর্ম নয়। শিল্পী সাহিত্যিক কবি, বুদ্ধিজীবী, সঙ্গীত শিল্পী বিজ্ঞানী কেউ-ই এই অবস্থার বাইরে নন। ফলে সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রে এর প্রভাব দুঃখজনকভাবে বিদ্যমান এবং সৃজনের ক্ষেত্রে তারা অন্ধত্ব দ্বারা আচ্ছন্ন এবং ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।


০৩.
কবি শিল্পীরাও চিন্তার আবদ্ধতায় আটকে থাকে। তারা আধুনিক কবিতার কথা বলে কিন্তু প্রকাশে সেই পুরানো চিন্তা, পুরানো শৈলী, প্রেমের নামে দেহজ প্রেমের ভাঁড়ামী, উপলব্ধিহীন রূপায়ন ইত্যাদির জগাখিচুড়িই নির্মাণ করে; বিজ্ঞান দর্শন ইতিহাস চেতনার চেয়ে বেশি থাকে পরকীয়া, ভাববাদী মারফতির জয়গান। যদিও কবিতা প্রসঙ্গে অনেক বিষয়ে তারা সম্যক ওয়াকেফহাল কিন্তু অভ্যেসের বাইরে দাঁড়াতে পারেন না। কবিরা ভাবনায় চাঁদ, তারা, গ্যালাক্সি, উল্কা, ধূমকেতু, রংধনু, আরো কত কী প্রকাশে দেদার ব্যবহার করছেন তা সকলই বস্তু। বিশ্বটাই বস্তুময়। বস্তুই চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বস্তুতে ভাবনার দোলা। আর এসব বস্তুর চেতনাজগৎকে আলোড়িত করে, নতুন সংবেদনার সৃষ্টি করে। কাব্যে যা অবাস্তবতা, বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতা নানা রূপকাঠামোয় প্রয়োগ কৌশলে অর্থপূর্ণ, সুন্দর, সুষমাময়, উদ্দীপন হয়ে ধরা দেয় । সমাজই ওইসব বস্তুর বিষয়গুলো তাকে জানতে, বুঝতে, অনুধাবন করতে সুযোগ দিয়েছে, খুঁজতে অণুপ্রেরণা দিচ্ছে, নতুনভাবে আবিষ্কারে উদ্বুদ্ধ করছে, আর তা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে সমাজে। সমাজ তার ভোক্তা। অর্থনীতির নানা মারপ্যাঁচে পড়ে প্রতিদিন মানুষ বিচ্ছিন্ন সত্তায় পরিণত হচ্ছে। তা ব্যক্তি টের পায় না। যদি না তার উপলব্ধি নিজের মধ্যে জাগ্রত করে। যদি না অনুভব করতে চেষ্টা করে আমি মোটেও কোনো আমি নয়, আমি বিশাল আমির এক অবিচ্ছিন্ন সত্তা যা বিভাজিত হয়েছে এবং পতিত সত্তায় রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু সেই সামাজিক সত্তা সমাজ থেকে ক্রমান্বয়ে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে কী করে? সেটাই রাজনীতি, তার প্রকাশ তার বিকাশ, তার বৃদ্ধির যে ছিটে-ফোঁটা ঘোষণা সবই এই চিন্তার ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ‘তুমি মেষ, হৃষ্ট-পুষ্ট যতই হও না মাংস তোমার নয়’। লেখকরা কি তবে নিয়তিবাদীর মতো নিজের প্রাপ্তির লোভে অন্যকে প্রতারণাই করে যাবে তার সৃষ্টিতে?

 


আরো সংবাদ



premium cement
দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১ মনুষ্য চামড়ায় তৈরি বইয়ের মলাট সরানো হলো হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে বর্জন করতে হবে : ডা: ইরান আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা ভিয়েনায় মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রদূতদের ইফতারে ইসলামিক রিলিজিয়াস অথোরিটি আমন্ত্রিত এবার বাজারে এলো শাওমির তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি সকল কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি থাকতে হবে : মাওলানা হালিম বিএনপি জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি করে : ড. মঈন খান সাজেকে পাহাড়ি খাদে পড়ে মাহিন্দ্রচালক নিহত

সকল