২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নজরুলের কবিতায় ঈদ

নজরুলের কবিতায় ঈদ -


দীর্ঘ এক মাস সাওম সাধনা শেষে, আমাদের মাঝে আসে ঈদ বা ঈদুল ফিতর। ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। এটি মুসলিম তথা আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব। ঈদুল ফিতরে জনমনে থাকে আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের ঢেউ। ঈদের আগের দিন থেকেই শুরু হয়, আগাম প্রস্তুতি। সর্বত্র বাজতে থাকে কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে,
এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে
শোন আসমানি তাগিদ’

কাজী নজরুল ইসলাম কবি, বড় কবি, আমাদের জাতীয় কবিও। বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে তার রয়েছে যথেষ্ট অবদান, রয়েছে সব শাখায় বিচরণ। তিনি লিখেছেন অনেক ইসলামী কবিতা,গান ও গজল। তাঁর ইসলামী এসব লেখার মধ্যে, ঈদ নিয়ে লেখা কবিতা, গান ও গজলগুলো বাংলা সাহিত্যে ও আমাদের হৃদয়ে বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। কারণ বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো কেউ ‘ঈদ’ নিয়ে এত লেখালেখি করেনি। বাংলা সাহিত্যে ঈদ নিয়ে নজরুল-ই এককভাবে সবচেয়ে বেশি রচনা করেছেন। ‘শহীদী ঈদ’, ‘ঈদের চাঁদ’, ‘কৃষকের ঈদ’, ‘বকরীদ’, ‘ঈদ মোবারক’, ‘জাকাত লইতে এসেছে ডাকাত চাঁদ’, ‘কোরবানি’, ‘আজাদ’ এগুলো তাঁর ঈদের কবিতা। নজরুলের ঈদবিষয়ক গানগুলো হলো ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’, ‘নতুন ঈদের চাঁদ’, ‘চলো ঈদগাহে’, ‘ঈদ ঈদ ঈদ’, ‘নাই হল মা বসন-ভূষণ এই ঈদে আমার’, ‘ছয় লতিফার ঊর্ধ্বে আমার আরাফাত ময়দান’, ‘ঈদুজ্জোহার তকবির শোনো’, ‘ঈদ মোবারক হো’, ‘ঈদের খুশির তুফানে আজ ডাকল কোটাল বান’, ‘ফুরিয়ে এল রমজানেরই মোবারক মাস’, ‘নতুন চাঁদের তকবির, ঈদুজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ’, ‘দে জাকাত দে জাকাত, তোরা দেরে জাকাত’, ‘ঈদ মোবারক হোক ঈদ মোবারক হোক’, ‘ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক’। তা ছাড়া ‘ঈদুজ্জোহা’ ও ‘ঈদুল ফেতর’ নামক দুটি নাটিকাও রয়েছে।
দীর্ঘ একমাস রোজা শেষে পশ্চিম আকাশে যখন এক ফালি চাঁদ দেখা যায়,মানুষের মনে তখন আনন্দের জয়ধ্বনি। এ জয়ধ্বনি কবি প্রকাশ করেন, তার কবিতার ভাষায়। বলেন-


এল ঈদুল ফিতর এল ঈদ ঈদ ঈদ
সারা বছর যে ঈদের আশায় ছিল না ক’নিদ
রোজা রাখার ফল ফলেছে দেখ রে ঈদের চাঁদ
সেহরি খেয়ে কাটল রোজা, আজ সেহেরা বাঁধ।
রোজার আত্মশুদ্ধি ও ধৈর্য পরীক্ষা শেষে, ঈদ অনেক আনন্দ নিয়ে আসে। সেই আনন্দ-ই কবি তাঁর কবিতায় প্রকাশ করেন,
ফিরদৌসের শিরনি এল ঈদের চাঁদের তশতরিতে
লুট করে নে বনি আদম ফেরেশতা আর হুরপরীতে
চোখের পানি হারাম আজি
চলুক খুশির আতসবাজি।


ধনী-গরিব সবার জন্য-ই ঈদ, সবায় চায় ঈদ। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত অনেক কৃষক, মজুর বা গরিব মানুষ আছেন যাদের জন্য ঈদ খুশি নিয়ে আসে না। যদিও তারা খুশি থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। নজরুল তাদের দুঃখকষ্টও বুঝতেন। তাদের কষ্ট তুলে ধরেছেন নিজ কবিতায়। বলেন-
‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’
কবি এমন ঈদ প্রত্যাশা করতেন, যেখানে ধনী-গরিব সকলে আনন্দে থাকবে, ঘুচে যাবে সব বৈষম্য। এ নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি লিখেন-
সিঁড়ি ওয়ালাদের দুয়ারে এসেছে আজ
চাষা-মজুর ও বিড়ি-ওয়ালা
মোদের হিসসা আদায় করিতে ঈদে
দিল হুকুম আল্লাহতালা
দ্বার খোল সাততালা-বাড়ি ওয়ালা দেখ কারা দান চাহে
মোদের প্রাপ্য নাহি দিলে যেতে নাহি দিব ঈদগাহে।
কারো কাছ হতে সাহায্য না পাওয়ায়, কবি গরিব,অসহায়দের সান্ত¡না দিতেও সঙ্কোচ বোধ করেননি। কবি নিজেকে অভাবী শ্রেণীদের প্রতীক ভেবে কবিতায় বলেন-
নাই হলো মা বসন-ভূষণ এই ঈদে আমার
আল্লাহ আমার মাথার মুকুট রসুল গলার হার॥
নামাজ রোজা ওড়না শাড়ি
ওতেই আমায় মানায় ভারি
কলমা আমার কপালের টিপ
নাই তুলনা তার॥


গরিব-অসহায় শ্রেণীদের কষ্টে ঈদ অতিবাহিত করার প্রধান কারণ ধনী ব্যক্তিরা গরিবদের পাশে না দাঁড়ানো। বেশির ভাগ ধনী ব্যক্তিরা-ই ভুলে যায় মানবতা, ভুলে ইসলাম। কেননা ইসলাম মানবতার কথা বলে, শান্তির কথা বলে, বলে সমবণ্টনের কথাও। তাই কবি ইসলামের বাণী স্মরণ করিয়ে দিয়ে কবিতার ভাষায় বলেন,
‘ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ-দুখ সম-ভাগ ক’রে নেব সকলে ভাই,
নাই অধিকার সঞ্চয়ের।
কারো আঁখি-জলে কারো ঝাড়ে কিরে জ্বলিবেদীপ?
দু’জনার হবে বুলন্দ-নসিব, লাখে লাখে হবে বদনসিব?
এ নহে বিধান ইসলামের॥’
সমাজের বিত্তবান ও ধনিক শ্রেণীদের উচিত মানবিক হওয়া, ভ্রাতৃত্বের আদর্শকে সমুন্নত রাখতে অভাবীদের নিয়ে ভাবা, সাহায্য করা ও ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী চলা। তাহলে-ই আশা করা যায়, সাহায্য ও দান করার মাধ্যমে তাদের অভাব লাঘব হবে।
নজরুল এ প্রসঙ্গে বলেন-
ঈদ্-অল-ফিতর আনিয়াছে তাই নব বিধান,
ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান,
ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার!
ভোগের পিয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,
তৃষ্ণাতুরের হিসসা আছে ও পিয়ালাতে,
দিয়া ভোগ কর, বীর, দেদার।


কারণ ইসলামে অভাবীকে খাবার খাওয়ানো মানে আল্লাহকে খাবার খাওয়ানো, আল্লাহকে খুশি করা। হাদিসেও বিস্তারিতভাবে তা আলোচনা করা হয়েছে। যে আল্লাহকে খুশি করতে পারবে, তার ঈদ হবে শ্রেষ্ঠ ঈদ।
কাজী নজরুল ইসলাম ‘ঈদ’ নিয়ে দু’টি নাটিকা করেছিলেন। ‘ঈদ’ নাটিকায় মাহতাবের কণ্ঠে বলেন-
আমি আল্লাহকে পেলাম। তারই অস্তিত্ব তাঁরই ইচ্ছার সৃষ্টি তোমাদের সবাইকে পেলাম। তাই আমার ঈদ ফুরায় না, আমার ঈদ ফুরায়, আবার আসে।
আমাদের সবার উচিত, নজরুলের কবিতায় উজ্জীবিত হয়ে গরিব অসহায় মানুষদের পাশে ধারানো, তাদেরকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া ও ধনী-গরিব বৈষম্যহীন এক ঈদ উদযাপন করা। যে ঈদে আমরা পরস্পরকে বলব- ‘ঈদ মোবারক’। এ নিয়ে কবি নজরুল বলেন-
পথে পথে আজ হাঁকিব, বন্ধু,
ঈদ-মোবারক! আসসালাম!
ঠোঁটে ঠোঁটে আজ বিলাব শিরনী ফুল-কালাম!
বিলিয়ে দেওয়ার আজিকে ঈদ।
আমার দানের অনুরাগে-রাঙা ঈদগা রে!
সকলের হাতে দিয়ে দিয়ে আজ আপনারে-
দেহ নয়, দিল হবে শহীদ॥


আরো সংবাদ



premium cement

সকল