২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভোর চারটা বেজে সতেরো মিনিট

-

‘দোল দোল দুলুনি....’
পাশের রুমে ইয়াগিজকে ঘুম পাড়াচ্ছে ওর মা। আজ দশ দিন হলো দ্বিতীয় সন্তানের আগমন ঘটেছে আমাদের ঘরে। বড় ছেলে মেহমেতও ঘুমিয়ে পড়েছে। ভারী কম্বলটা দিয়ে ছেলেকে ভালো করে ঢেকে দিলাম। গত ক’দিন ধরে বড় ছেলেকে সাথে নিয়ে ঘুমাচ্ছি আমি। রাত থেকে হঠাৎ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়েছে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে পাঁচতলা ফ্ল্যাটের সুবিশাল জানালা দিয়ে বাইরে তুষার পড়তে দেখেছি। কিছুক্ষণ পরেই চারদিকে আলো ফুটে যাবে। এখন উঠে সকালের নাশতাটা রেডি করলে নিকোলার কষ্ট কম হবে। বেচারি দুই ছেলেকে নিয়ে পেরে উঠবে না। ভাবতে ভাবতে বেডে উঠে বসলাম। হঠাৎ মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। এত দুবল হয়ে গিয়েছি! কালই ডক্টরের এপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। আসলে বাসা অফিস সামলিয়ে বেশ চাপ পড়ে যাচ্ছে ইদানীং। এক পা মেঝেতে রাখতেই মনে হলো পুরো ফ্ল্যাট কেঁপে উঠলো। একবার না বারবার। কাঁপতেই থাকলো। অনবরত। তারমানে এটা... ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই দ্রুত ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে তুলে নিলাম। মাথায় একটাই চিন্তা এখান থেকে বের হতে হবে আমাকে। ভয়ে ছেলেকে সজোরে বুকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়াতেই ওয়্যারড্রবটা সশব্দে আছড়ে পড়লো যেন।
-ইয়া আল্লাহ... ব্যথায় মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাচ্ছি। তীব্র ব্যথায় ছেলেটাও কেঁদে উঠলো।
আল্লাহ গো এখন কী করবো?
যেন পাহাড় ভেঙে পড়ছে শরীরে ওপরে। আচড়ে-পাচড়ে ওঠার চেষ্টা করেও একচুলও নড়তে পারলাম না।
-বাবা...ব্যথা...ওহ... মাসুম বাচ্চাটার আর্তচিৎকার আমার বুকের ভেতরটা কাঁপিয়ে দিয়ে গেল।
-আল্লাহ...আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আমার ছেলেকে বাঁচাও। অসহায় কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি।
-মেহমেতের বাবা... অসহ্য ব্যথায় ডুবতে ডুবতে একটা চিৎকার শুনতে পেলাম।
-পালাও ... পালাও... বিরবির করে বলতে লাগলাম আমি।

২.
ছেলেকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিল নেকলা। হঠাৎ পুরো বিল্ডিং যেন কাঁপতে শুরু করেছে। দেয়ালগুলো যেন ভেঙে চৌচির হতে শুরু করেছে। ছাদ থেকে ইট খুলে পড়ছে। সম্বিত পেতেই দশ দিনের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে পাশের রুমে স্বামী ও বড় ছেলের কাছে যাওয়ার জন্য দৌড় শুরু করে নেকলা। কিন্তু তাদের কাছে পৌঁছাতে পারে না সে। শখ করে বানানো প্রমাণ সাইজের ওয়ারড্রোবের নিচে চাপা পড়ে আছে প্রাণপ্রিয় স্বামী আর সন্তান। হতবুদ্ধি নেকলা স্বামীর বলা পালাও... পালাও কানে আসতেই ইয়াজদিগকে বুকে চেপে ধরে সামনে আগাতে চাইলো। ততক্ষণে ভূমিকম্পের প্রচণ্ড কাঁপুনিতে ঘরের দেয়াল ভেঙে পড়তে শুরু করে। নেকলার মনে হচ্ছে তাদের বিল্ডিংটা যেন হাওয়ায় জাহাজের মতো উড়ে চলেছে। থামগুলো ভেঙে একের পর এক পড়তে লাগলো। প্রচণ্ড আতঙ্কে ছোট ছেলেকে সজোরে বুকের সাথে চেপে ধরে নেকলা। বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত হতে থাকে সে। ভাগ্য ভালো হলে হয়তোবা কেউ আসবে তাদের উদ্ধারে। ভাবতে ভাবতে জ্ঞান হারায় নেকলা।
ওদিকে ওয়্যারড্্রবের নিচে চাপা পড়া অবস্থায় অসহ্য ব্যথায় ধুঁকতে ধুঁকতে শেষবারের মতো নিচে পড়ে থাকা ঘড়ির দিকে চোখ গেল আমার। ঘড়িটাও কাঁপছে থরথর। সোডিয়ামের কাঁটাগুলো জ্বলজ্বল করছে। ঘড়ির কাঁটাগুলো কি থেমে আছে? হাতা প্রদেশে এখন সময় ভোর চারটা বেজে সতেরো মিনিট।


আরো সংবাদ



premium cement