২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

শিল্প ও সময়ের প্রকাশ

-


পীড়িত সমাজের কিছু সৃষ্টিশীলদের মধ্যের বেশির ভাগের মানসিকতা হচ্ছে সমাজে বহিরাগতের মতো। জীবনের বেহাল দশায় যেন তাদের কিছু যায় আসে না। তারা আনন্দমার্গে মানুষকে চুবিয়ে রাখতে বেশি পছন্দ করেন। তারা মনে করেন সমাজের অসঙ্গতিতে তাদের কিছুই করার নেই। তারা তাদের মেধা-যোগ্যতা কে নিবেদিত করেন ‘সৃষ্টি, সৃষ্টির উদ্দেশ্যে’র জন্য। তারা মনে করেন সৃষ্টির কাজ নিজেকে আনন্দিত করা অন্যকে তার মতো মনোসুখ দেয়া। কিন্তু সমাজটাই যদি ক্রমাগত অসহনীয়, অসুস্থ এবং অমানবিক হয়ে ওঠে সে ক্ষেত্রে তারা ভাবেন; এ কাজ রাজনীতিবিদের, সমাজ সংগঠকের। কে খুন হলো, কে ধর্ষিত হলো, কার বাড়ি জ্বললো, কে সাম্পদায়িকতার চক্রান্তে পুড়লো, কে দেশান্তরী হলো, কে দেশ লুট করলো, কার জিহ্বা কাটা গেল, কারা নেশায় ডুবে গিয়ে শিক্ষা কর্ম থেকে বিচ্যুত হলো, কারা কোনসুরে জঙ্গি হলো এর প্রতিকার প্রয়োজনে তাদের কিছুই করার নেই। তারা ভাবেন জনগণও এসব নিয়ে ভাবেন না তারাতো সংবাদও পড়েন না, আর তারা হলেন হাওয়ায় ফুরফুর বুদ্ধিজীবীদের কেউ একজন। বুদ্ধি বিক্রিই তাদের কাজ, মগজ বিক্রি তাদের পেশা। তারা মান্য করেন তুলি হাতুড়ি কিংবা কলম যোদ্ধাদের এর চেয়ে বেশি কিছুর দায়িত্ব নেই, তা হলে সৃষ্টি সত্তার মান হারাবে। এবং তারা রাজরাজার অনুগ্রহ থেকেও বঞ্চিত হবেন -। এই সত্যে তারা ভাব-ব্যধিকে উপযুক্ত মনে করেন এবং প্রত্যাশা করেন উপযুক্ত ক্ষমতা তাদের অনুগ্রহ করুক। তখন এই সব শিল্পী কবি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবেন ক্ষমতার দাওয়াত পাবেন এবং জনগণ তাদের শ্রদ্ধা দেবে, সংগঠন তাদের পুরস্কৃত করবে। উচ্ছিষ্টে তাদের মন টনটন করে। তারা প্রকারন্তে মানুষকেই বিভ্রান্ত করেন; এবং মানুষের অবশ-বিবশ মনোজগতকে বিকালঙ্গকরণ প্রকৃয়ায় সহায়তা দেন। প্রত্যেক লেখক শিল্পী কণ্ঠি নাচিয়ে গাইয়ে সুরস্রষ্টা সকলেই সামাজিক মানুষ, সমাজের প্রতি তাদের দায় রয়েছে। সমাজ যখন সতেজ, তরতাজা, চনমনে থাকে তখনও তাদের দায় ফুরিয়ে যায় না।


তাকে আরো বেশি যত্ন দিয়ে নিজেদের প্রকাশকে মানুষমুখী করার দিকেই সৃষ্টিশীলকে গুরুত্ব দিতে হয়। তবে হের ফের আছে, লড়াইয়ের ময়দানে বিপক্ষকে যেমন ছাড় দেয়া যায় না, লড়াই শেষে যেমন সম্পর্ক ও ভালোবাসা বিশ^াস ইত্যাদির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্র সম্পর্ককে আরো ঘনো টেকসই করে নেয়ার চেষ্টাকে অব্যাহত রাখে; ঠিক তেমনি নিদান কালের সকল নন্দন ভাব তাড়িত শিল্প মোহযুক্ত হলেও অবরুদ্ধ মানুষ তাকে ছেড়ে যায়। [কেবল কতিপয় পরশ্রম ভোগীরা বিজ্ঞজনের মতো বাহ্ বাহ্ করে।] কারণ এসব বুঝবার, অনুভূতিতে নেয়ার সমস্ত মানসিক আয়োজন তার মগজ থেকে বিতাড়িত হয়ে আতঙ্কময় পরিস্থিতে পড়ে চেতনা হারায়। সে ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল মানুষের বাঁশির সুর কেবল বাতাসেই ভেসে বেড়ায়, কিংবা দিস্তাদিস্তা কাগজের অপচয়সহ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সুবিধা কামায়- যারা এর ভোক্তা, যাদের কাছে এর উপযোগিতা তারা আর মুখ তুলে তাকাতে, শ্রবণে শ্রান্তি বিলোপে, বিশ্বাসে নতুন রূপলাবণ্যের চিত্রকল্প তৈরিতে পারঙ্গম হয় না। কিন্তু যখন শিল্পী তার চারপাশের সমাজ মানুষের ভিড়ে নেমে পড়েন এবং মানুষের সংগ্রাম বীরত্ব, পরাজয়, ইত্যাদিকে মৌলিক করে সম-সাময়িক ঘটনাবলির সূত্রগুলো তাদের সৃষ্টিতে শিল্পের নিয়মে রজ্জুবদ্ধ করেন তখন তাদের ব্যতিক্রমগুলোও ভোক্তা গ্রহণে সক্ষম হন, আনন্দপান। এবং সৃষ্টিকে নিজের বলে গ্রহণ করেন। অনেক আলোচক মনে করেন সৃষ্টিশীল মানুষ রাজনৈতিক হত্যা, নিষ্পেষণ সম্পর্কে উদাসীন থাকবে, শুধু সৌন্দর্য, প্রেম ভালোবাসায় মগ্ন থাকবে। তারা আরো মনে করেন এসব দেখবার ভাববার উপায় রাজনীতিকদের সৃষ্টিশীলদের এতে কোনো দায় নেই। তারা সমাজের খায়, শেখে পুষ্ট হয় এবং নিজেদেরকে কৃষ্ণ কৃষ্ণ ভেবে তৃপ্ত হয়। তারা জীবনের সবকিছু দিয়ে এবং জীবিত মানুষের আগামীর জন্য অবশিষ্টটুকু সম্পদে তৈরি করার প্রেরণা প্রেরণে নিজের সুবিধাটুকুর বিসর্জনের মধ্যে মহত্ত্বকে স্পাপন করতে পারেন না। তারা টিকে গেছেন যাবেন এবং অনাদিকাল মানুষ তার মেধার গৌরবে নৃত্য করবে এমন-ই ভাব তরঙ্গে ভাসতে থাকেন। তারা ভাবেন না পৃথিবীতে আজ যা প্রয়োজন তা আগামীতে মানুষ ইতিহাসের পাতায় খুঁজবে, যেমন আমরা গ্রিক সমাজের শিল্প সাহিত্য কলা সম্পর্কে জ্ঞান সংগ্রহ করি ইতিহাসের পাতা থেকে এবং তাদেরকে জানি তাদের সৃষ্টি থেকে, যেমন আমরা জানি দাসদের বিদ্রোহ তাদের সৃষ্টি ভাবনা মুক্তির। [যা এখনও ভিন্ন প্রেক্ষাপট তৈরি করে] আজকের সেই প্রেক্ষাপট বদলে নতুন কাঠামোতে লড়াইটা যেমন দরকার হবে দরকার হবে তেমনই এক উপযুক্ত চিন্তাকাঠামো যা সৃষ্টি করেন সমস্ত অনুভূতি দিয়ে সৃষ্টিশীল মানুষেরা। এই ক্ষেত্রে আপোষ নগ্নতারই প্রকাশ।


সমাজ বিকাশের প্রয়োজনে সুরছন্দ বদলাবেই। মনে রাখতে হবে সমাজ বর্তমান অবস্থায় যে আছে, এবং বিশ^-ব্যবস্থা প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণে যে ভাবে বদলাচ্ছে সে ভাবেই বদলে যাচ্ছে মানুষের মনোজগত। পুরনো সামন্তীয় সমাজের অনুভূতিগুলো যদিও এখনো আমাদের মনজগতে ছত্রাকের মতো আটকে আছে, তারও খামতি ঘটবে নতুন জীবনে। হারিয়ে যাবে অনেক কিছু, যুক্ত হবে বহুকিছু, গ্রহণে বর্জনে পুষ্ট হবে আগামীর সমাজ। সেখানে সৃষ্টিশীল মানুষের বহুতর দায় অবশ্যই বর্তমান। শিল্প-সত্তা এমনই এক বিষয় যা একই সাথে গ্রহণও করে বর্জনও করে। এভাবেই ঐতিহ্যকে নবায়ন করে। নিৎশের একটা কথা আছে ‘কোনো শিল্পীই বাস্তবকে সহ্য করে না’। ঐক্য এবং সংস্কৃতির বহুকিছু বর্জন/গ্রহণের মধ্যে শিল্পসত্তার বিকাশ। শিল্পও সময়ের প্রকাশ, সময়ের রূপরুচি যদি বহুদিন বিরাজমান থাকে একই রূপ কিংবা রূপের পার্থক্য মূলের ঐক্যেরসাথে জুড়ে থাকে সেখানে সেই সময়টুকু সৃষ্টির আলোড়ন, তা যদি টিকবার মতো মানুষের মনোজগতমূলকে ছুঁয়ে থাকে। এই হলো কাল-উত্তীর্ণের প্রেরণা পত্র। কিন্তু যদি সমাজটা বৈপ্লবিক ভাবে বদলে যায় [যা আমরা দেখেছি তার অভিজ্ঞতার মতো নয়] প্রকৃতই বদলায় তা হলে তার মানুষের প্রয়োজনটা হবে অন্যরকম। এসব নয়। যেমন আদি কালের সৃষ্টি আজ আর কাউকে অনুপ্রাণিত করবে না, তবে শিক্ষণীয় বহু বিষয় তার মধ্যে আছে যা এই বর্তমান সৃষ্টির ভাগ্যের সাথে পাশাপাশি ইতিহাসের উপাদান হবে। চিরস্থায়ীত্ব কোনো কিছুর নেই বিশ্বাসেরও।


আসলে যদি তারা সমাজব্যাধি নিয়ে লেখেন, আঁকেন, কণ্ঠ দেন, প্রতিকারবিহীন, মানবতা বিবর্জিত রূপ তাদের সৃষ্টির বিষয় হয়ে ওঠে এবং সৃষ্টিকে রাজনৈতিক, কিংবা দলীয় প্রচারে পরিণত না করে ন্যায় ও ন্যায্যতাকে মান্য করেন তার মধ্যদিয়ে তারা হয়ে উঠতে পারেন জনগণের একজন। এভাবেই তারা তাদের সামাজিক রাষ্ট্রিক দায়িত্ব পালনে মহানুভবতা দেখাতে পারেন। জনগণের একজন হওয়ায় কোনো দলীয় আদর্শের কিংবা হাট ইজারাদারের কৃপা পাবার প্রয়োজন পড়ে না, তিনি বা তারা নিজেরাই সৃষ্টি করতে পারেন নিজেকে পুনরবার।
চমৎকার এই মানসিকতা যা ইঙ্গিত করবে আগামীর উত্তোরণে তার দিকে কেবল একজন দায়িত্ববান শিল্পীই নজর দিতে পারেন, সমাজে অগ্রসরমান একজন ব্যক্তি হিসেবে, যে দায়িত্ব সমর্পণ নিজ তাগিদের, মানুষের প্রতি অকৃতিম ভালোবাসার। আসলে নিজ নাম খ্যাতি প্রাপ্তি ইত্যাদির শঙ্কা তখনই দূর হতে পারে যখন কোনো শিল্পী কবি নিজেই উপলব্ধি করেন আগামী সমাজ কতোটা তার সৃষ্টির জন্যও প্রয়োজন। তখনই তাদের সৃষ্টি সময়কে অতিক্রম করতে পারবে। আর এসবের প্রয়োজনে বিষয়কে যেমন বেছে নিতে হয় পারিপাশির্^কতা থেকে তেমনি তা প্রকাশের জন্য কাঠামোকেও বিন্যস্ত করতে হয়ে মোহান্ধতা পরিহার করে। নন্দন নন্দন বলে চিৎকার না করে নতুন নন্দন সৃষ্টিতে পারঙ্গম হয়ে ওঠা আজ বড় প্রয়োজন। তখন ইতিহাস দুর্দমনীয় কাজ করবে। যা কিছু টিকবার তা টিকবে মানুষের মধ্যে আর যা কিছু বর্জনীয় তাও বর্জিত হবে মানুষ দ্বারা। সৃষ্টিশীলকে মনে রাখতে হবে, মানুষের বর্তমানের পরেও মানুষ আছে, তার মধ্যেই পরকালের সিদ্ধি।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
মহানবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে লালমোহনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ক্রিমিয়া সাগরে বিধ্বস্ত হলো রুশ সামরিক বিমান জর্ডান আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশী বিচারক এবারের আইপিএলে কমলা ও বেগুনি টুপির লড়াইয়ে কারা সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে গেছে : রিজভী রাশিয়ার ৯৯টি ক্ষেপণাস্ত্রের ৮৪টি ভূপাতিত করেছে ইউক্রেন আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে দাগনভুঞার যুবক নিহত কাশ্মিরে ট্যাক্সি খাদে পড়ে নিহত ১০ অবশেষে অধিনায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছল পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান

সকল