২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

উদাসী কুয়াশার চাদর

-

ষড়ঋতুর রঙে রঙিন আমাদের দেশ। বর্ণিল প্রকৃতির ঋতু বাংলাদেশ তার ছন্দময় ও আনন্দময় অনুপম বিস্তার করে। শীতকাল আমাদের পঞ্চম ঋতু। হেমন্তের গায়ে বার্ধক্য ফেলে বসন্তের আগেই আগমন হয় এ ঋতুর। পৌষ-মাঘ এ দুই মাস মিলে শীতঋতু। তবে শীতের আমেজ শুরু হয় হেমন্তের অর্থাৎ অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি সময়ে। শুষ্কতা, রিক্ততা আর দিগন্তব্যাপী সুদূর বিষাদের প্রতিমূর্তি সে। কুয়াশায় ঢেকে যায় নির্জন বন-মাঠ আর নদীকূল। উত্তর দিগন্তে হিমালয়ের বরফচূড়া থেকে ছড়িয়ে পড়ে হিমশীতল নিঃশ্বাস। শীতের আগমনের সাথে বনভূমিতে শুরু হয় হাহাকার। মালতীলতার পত্রশূন্য, ঝুমকো লতার রঙ ফুরায়, পাতায় পাতায় ঘাসে ঘাসে পাণ্ডুরতা। তবু শীতের মাধুর্য আছে। প্রকৃতিতে সে স্নিগ্ধ পরশ বোলায়। সে কেবল বৈরাগী, উদাসীন নয়। বাংলার মানুষ শীত ভালোবাসে।
শহর থেকে গ্রামবাংলায় শীতের প্রকোপ একটু বেশি। আশ্চর্যজনকভাবে সারা গাঁ কুয়াশায় ঢেকে নেয়। সে সৌন্দর্য কেবল দর্শন আর উপভোগেরই। কোথাও কিছু দেখার উপায় নেই ঘরবাড়ি, বাঁশঝাড়, জলাশয় এবং বিশাল প্রান্তজুড়ে শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। টুপ করে ঝরে পড়া গাছের পাতায় থাকা শিশিরের শব্দ মনকে বিমোহিত করে। ছোট্ট মনটা তখন ছুটে যায় দূরের ওই মাঠ-ক্ষেতে। ভোরের নরম আলোয় শিশিরবিন্দু ঘাসের ডগায় বসে মিটিমিটি হাসে। কাটা ধানের নাড়া নীহারে ভিজে চপচপ হয়ে থাকে। পায়ে ছোঁয়া লাগা মাত্রই সারা শরীরে একটা ঝাঁকুনি খেলে যায়। খেজুরগাছের মাথায় ঝুলে থাকা মিষ্টি রসের হাঁড়িটি সকালকে কল্পনার রাজ্যের স্বর্গপুরী বানিয়ে তোলে। জ্বলন্ত উনুনের পাশে বসে গরম ধোঁয়া উঠা ভাপা পিঠা আর খেজুর রসের স্বাদে মন উন্মাতাল হয়ে যায়। পিঠা পার্বণের ঋতু হিসেবে খ্যাতি রয়েছে শীতকালের। এটা যেন একটা আদর্শ সময়।
শহুরে শীত, গ্রাম থেকে কিছুটা অন্য ধাঁচের। সকালে মিষ্টি আলো ফোটার আগেই ঘুম ভাঙে নগরবাসীর। গ্রামের মতো নেই শীতের তীব্রতা। শহরের কর্মময় জীবন আর বিশাল অট্টালিকার মাঝে হারিয়ে যায় শীত সকালের সোনালি মিষ্টি রোদ। তবুও শীত আসে শহরের নাগরিক ব্যস্ততার মাঝে। এখানে জ্যাকেট-সুয়েটারেরও তেমন প্রয়োজন হয় না। তবুও শীত এলে খোকাখুকিদের নতুন নতুন জামা জ্যাকেট কেনার শখ জাগে। শীত তাদের মনে আনন্দের দোলা দিয়ে যায়। যেন অন্য ঋতু থেকে শীতের ঋতুটা তাদের বেশি প্রিয়। বাবা, মার কাছে তাদের প্রথম বায়না নতুন কাপড় কিনে দিতে হবে। তবে ফুটপাথে, বাসস্ট্যান্ডে, রেলস্টেশন ও বস্তিতে বসবাসরত মানুষদের ঠকঠক কাঁপতে দেখা দৃশ্য কিছুটা হলেও জানান দিয়ে যায় শীতের রেশ মাত্রা। এদের কেউ কেউ আবার ছেঁড়া কাগজ বা শুকনো পাতায় আগুন জ্বালিয়ে তাপ পোহায়।
গ্রামের মতো শহরেও দেখা যায় সকাল-বিকাল রাস্তার পাশে ফুটপাথ, বিভিন্ন গলি-ঘুপচিতে গ্রামের মতো শহরেও বানানো হয় ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা। শীতকালে আমাদের দেশে আগমন ঘটে অতিথি পাখিদের। এরা ঝাঁক ঝাঁক ধরে উড়ে আসে। দেখতে বেশ বড়সড়। গ্রাম-গঞ্জে অগণিত অতিথি পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে এলাকাগুলো।
শীতকালে নানান ফুল ফোটে ষড়ঋতুর বাংলায়। ফুলের মধ্যে রয়েছে চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, অ্যাস্টার, ডেইজি, কসমস, সিলভিয়া, এন্টিরিনাম, ন্যাস্টারশিয়াম, প্যানজি, ডায়ান্থাস, ফ্লক্স, ভারবেনা, কারনেশান, পপি, সূর্যমুখী, পর্টুলেকা, ক্যালেন্ডুলা, হলিহক, মর্নিং গ্লোরি, সুইট পি, অ্যাজালিয়া, জারবেরা, গ্ল্যাডিওলাস প্রভৃতি।
শীতের সময়ে অন্যান্য সময়ের তুলনায় ফলের সমারোহও অধিকাংশ দেখা যায়। শীত এলে কিছু মৌসুমি ফলও চলে আসে বাজারে। দেখা মেলে- বরই, জলপাই, আমলকী, সফেদা, কমলালেবু, আপেল আর ডালিমের। এসব ফলে আছে ভিটামিন ‘সি’, ভিটামিন ‘এ’, মিনারেল, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন ‘ই’, অ্যান্টিঅক্সিজেন, ফাইবারসহ আরো অনেক ভিটামিন।
শীত বেশির ভাগ লোকেরই প্রিয়। শীত আসে আনন্দ বদল করতে। হেমন্তের পালাবদলে উদাসী কুয়াশার চাদর গায়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে সর্ষে আর কলাইক্ষেত মাড়িয়ে বাংলার বুকে শীত আসে। উৎসব আর আনন্দে বরণ করা হয় শীত। শীত নানা ছবি এঁকে বিদায়ের পথ ধরে। এরপর আগমন ঘটে নতুন এক ঋতু বসন্তরাজের।


আরো সংবাদ



premium cement