২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মা ভাত দাও

-

নয়নের বউয়ের কোলে ছোট্ট শিশু। কিছুক্ষণ আগে দলে দলে লোক এসেছে তাদের ভিটায়। শিশুটি এত লোক এক সাথে আগে দেখেনি; দেখে সে আনন্দ পায় হয়তো। হতভম্ব চোখে তাকায় চার দিকে। নয়নের বউ বারান্দায় বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে আছে। মাথায় কে যেন ঘোমটা টেনে দিয়ে গেছে কয়েকবার। সে খেয়াল করেনি।
কী-ই বা খেয়াল করে সে। নয়ন যখন সেদিন বিকেলে বাড়ি থেকে বের হয়, তখনো কি তার খেয়াল ছিল সে দিকে? কিংবা হয়তো সে বুঝতে চায়নি নয়নের সেদিনের যাত্রার বিষয়টি। প্রায় আট হাজার কিলোমিটার দূর থেকে একজন সুতা নাড়বেন আর হাজারে হাজারে, লাখে লাখে মানুষ কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে যাবে- এসব স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি নয়নের বউ। নয়ন তাকে কতবার বলেছে- ‘শোনো, সেই ভবনের নামে আর যে নেতার নামে হাজার কথা বলেছে নিন্দুকেরা, তারা কি প্রায় দেড়যুগ পেরিয়ে গেলেও সেই বাড়িটির কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করতে পেরেছে; কোনো অপরাধের তথ্য প্রকাশ করতে পেরেছে? দেখবে, একদিন নায়কের বেশে দেশে ফিরবে সেই বাঁশিওয়ালা।’ কিন্তু নয়নের বউ বোঝে এসব স্বপ্ন দিয়ে তার কোনো কাজ নেই। তার প্রয়োজন শুধু ভাতের, ঘরের আর মানুষে মানুষে সম্পর্কের। নয়ন তার বউকে সেদিন বিকেলে অধিকার আদায়ের দাবিতে গণসমাবেশের লিফলেট বিতরণে যাওয়ার আগে এ-ও বলেছে- ‘দেখো, তুমি যে ভাতের কথা বলো, ঘরের কথা বলো- জানো, আজ দেশের মানুষ কী রকম হাহাকারের মধ্যে আছে? খাদ্যের আর জীবনের ধোঁয়াশার মধ্যে মানুষকে আজ কিভাবে সংগ্রাম করতে হচ্ছে তুমি জানো না। আর সম্পর্ক? কিসের সম্পর্ক? দেশে এখন মানুষে মানুষে হিংস্রতার সম্পর্ক। সে জন্য দেশের মানুষ নানান প্রান্ত থেকে প্রতিবাদ করছে। দেখো সম্মেলনে লাখ লাখ মানুষ অধিকারের লড়াইয়ে সামিল হচ্ছে। আমি এই অধিকারের সংগ্রামে নিজেকে ঢেলে দিতে যাচ্ছি।’
নয়নের দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শুরু হবে একটু পরেই। প্রথম জানাজা হয়েছে গতকাল সন্ধ্যায় পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে। গতকাল বিকেলে দলের এক নেতা ঢাকা মেডিক্যালে পোস্টমর্টেম শেষে নয়নের মরদেহ রিসিভ করেন। তখন প্রেস ক্লাবে চলছে পার্টির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের জন্মদিনের আলোচনা সভা। দেশনায়কের এবারের জন্মদিনে কোথাও কোনো কেক কাটা হয়নি। আতশবাজি হয়নি। আগের দিন তিনি আট হাজার কিলোমিটার দূর থেকে পার্টি অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন, তার জন্মদিনে যেন কোনো আনন্দ করা না হয়। দেশের কোটি কোটি মানুষ যেখানে বিপন্ন- ভাতের অধিকার, ভোটের অধিকার যেখানে ভূলুণ্ঠিত, সেখানে তিনি কেক কাটার উৎসব দেখতে চান না। যখন কেক না কাটার ঘোষণার পেছনের কথা শুনছেন সমবেত দর্শক-শ্রোতা, ঠিক তখন মেডিক্যালের মর্গে কাটা হচ্ছে নয়নের দেহ। নয়নের মায়ের তখন কী অনুভূতি হয়েছিল, কে জানে। নয়নের মা কি বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন? অথবা তাঁরও কি ভেতর থেকে সব কিছু অচেনা কেউ টেনে হিঁচড়ে বের করে নিচ্ছিল? নয়নের লাশকাটা ঘরের দিকে ছুটছেন পার্টির এক সিনিয়র নেতা। আর অপেক্ষায় হাজার হাজার মানুষ। কখন জানাজার জন্য আনা হবে তাদের প্রিয় প্রতিবেশী, প্রিয় পরিজন নয়নকে। আর নয়নের পিতা? আজন্ম যে পরাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে পোড় খেয়ে খেয়ে জীবনের স্বাদটুকুও ভুলে গেছেন সেই কবে। তিনি? তিনি জানেন- পরাধীন বাঙালির মুক্তি নেই।
জানাজা শুরু হলে নয়নের বউ কার যেন মৃদু কথায় খানিকটা মুখ ঘোরাতে চেষ্টা করে। কেউ একজন খুব কাছে এসে বলছে- ‘নয়নের মুখ শেষবারের মতো দেখবি চল’ কিন্তু নয়নের বউ নড়ে না। রা করে না। নয়নের মুখ আজ তার অগোচরে বাংলাদেশের মুখ হয়ে উঠছে- সে কী করে জানবে সে-কথা? লোকেরা সারিবদ্ধভাবে দেখছে সে মুখ। সে মুখে প্রতিবাদের দাগ। ফেসবুকে লিখা হচ্ছে সে মুখের আদ্যোপান্ত বিবরণ। শেয়ারে, লাইভে ছড়িয়ে পড়ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নয়নের মুখ। যেন এ মুখ কেবল নয়নের নয়, এই মুখ ভোলার রহিমের, এই মুখ নারায়ণগঞ্জের আকাশের, এই মুখ মুন্সীগঞ্জের শাওনের, এই মুখ সিলেটের কামালের। এভাবে যুগের মানচিত্রে হাজার হাজার হারিয়ে যাওয়া মানুষের মুখ হয়ে ওঠে নয়নের মুখ। আট হাজার কিলোমিটার দূরে, দেশের এক বংশীবাদক বসে আছেন- হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা কি? তাঁর কাছেও কি পৌঁছে গেছে নয়নের বিবর্ণ মুখ? কী ভাবছেন তিনি? তাঁর জন্মদিনে এটিও কি একটি নতুন উপহার? তিনিও কি সাত সমুদ্রের ওপারে বসে নয়নের মুখের সাথে মিলিয়ে বারবার কাগছে এঁকে চলেছেন প্রিয় দেশের মুখ? নয়নের বউ শুনেছে, কালোদের এক নেতাকে বছরের পর বছর প্রতীক্ষা করতে হয়েছিল মানুষের মুক্তির জন্য। তিনি ছিলেন জেলখানার দেয়ালের ওপারে; কিন্তু আট হাজার কিলোমিটার দূর থেকে যে নেতা টেনে ধরেছেন না-গাওয়া গানের সুতা, তার ভেতর থেকে বেজে উঠছে যে গানের কলি, সেই কলির সুরের জলে আজ ভিজে চলেছে নয়নের বউয়ের বুক। নয়নের বউ জানে- বহুকাল আগে সেই সাত সমুদ্রের ওপারের শাদা শাদা লোকেরা শাসন করেছে এ দেশ। প্রায় ১৯০ বছর। তারপর তারা বিদায় নিয়েছে। আর এখন সেই ৭৯৯০ কিলোমিটার দূরের দেশ থেকে এক নেতা জাগিয়ে রেখেছেন এ দেশের পরাস্ত মানুষগুলোকে। পরাধীনতার জাল ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য ডাক দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেছেন- ‘দেশকে ফেরাতে হবে ভাতের দিকে, বাড়ির দিকে, চেনা মানুষের দিকে।’
অচেনা মানুষে ছেয়ে গেছে দেশ। লোকেদের চেহারা চেনা যায় না, চরিত্র চেনা যায় না, চাল ও চালাকি চেনা যায় না। কিন্তু এই যে আজ এই বাড়িতে- নয়নের বাড়িতে এত লোক- চেনা ও অচেনা। কারা এরা? নয়নের বউ একটু কেঁপে ওঠে। কে যেন তাকে ডাকছে, টেনে তুলতে চেষ্টা করছে, আর বলছে- ‘চল শেষ দেখাটা দেখে নে’। হ্যাঁ, এই শেষ দেখাই দেখতে গিয়েছিল নয়ন। সেদিন বলেছিল- ‘দেখো, এবার আমরা শেষ না দেখে মাঠ ছাড়ব না। খেলা না-কি শুরু হয়েছে। আমরা শেষ খেলা খেলতে চাই।’ এই ‘খেলা খেলা’ কথাগুলো নয়নের বউয়ের ভালো লাগেনি। মুখ চেপে সে বলেছিল- ‘এসব খেলা খেলা করো না তো। মানুষ মরছে না খেয়ে, মানুষ মরছে মানুষের জন্য, মানুষ মরছে দিনে ও রাতে, মানুষ মরছে বিনা কারণে। আর তোমরা খেলছ এসব নিয়ে। তুমি যাবে না ওসবে।’ কিন্তু নয়ন তো কারো কথা শোনেনি। সে শুনেছে নেতার সুতার টানের টানটান আওয়াজ। তার কানে প্রায় আট হাজার কিলোমিটার দূর থেকে ভেসে এসেছে ভাতের হাহাকার, ঘরের হাহাকার, মানুষের হাহাকার। নয়নের গায়ে কয়টি গুলি লেগেছিল? - একটি, দু’টি, তিনটি? নয়নের বউ এসবের কিছুই মনে করতে পারে না। পুলিশ এভাবে গুলি করল কেন? কী অপরাধ ছিল নয়নের? সে হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে।
প্রিয় মুখটি শেষবারের মতো দেখার জন্য যখন নয়নের বউ নিজেকে খানিকটা খাড়া করতে চেষ্টা করছে, তখন তার কোলে প্রায় ঘুমিয়ে থাকা ছোট্ট শিশু কঁকিয়ে ওঠে। ভাঙা ভাঙা গলায় শিশুটির মুখ থেকে বেরিয়ে আসে তিনটি শব্দ- ‘মা ভাত দাও’।


আরো সংবাদ



premium cement