১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এলো হেমন্ত

-

হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে
হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে
ঘরে ঘরে ডাক পাঠাল
দীপালীকায় জ্বালাও আলো
জ্বালাও আলো, আপন আলো,
সাজাও আলো ধরিত্রীরে।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাংলা বর্ষপঞ্জিতে হেমন্তের ব্যাপ্তিকাল কার্তিক ও অগ্রহায়ণ। হেমন্ত শরতেরই বিলম্বিত রূপ। বঙ্গ ঋতু নাট্যে সে চতুর্থ শিল্পী। উদাসীন পৌর এবং বিষণœ। হেমন্তে শরতের মতো নেই কোনো প্রাচুর্য। আছে সুদূর ব্যাপ্ত এক বৈরাগ্যের বিষণœতা। রূপসী হেমন্ত ধূসর কুয়াশায় নয়ন ঢেকে ফসল ফলাবার নিঃসঙ্গ সাধনায় থাকে নিমগ্ন। ক্ষেতে-খামারে ভারা ভরা সোনার ধান উঠে। চারিদিকে অন্তহীন কর্মব্যস্ততা, ঘরে ঘরে চলে নবান্নের উৎসব। পাচুর্যময়ী হেমন্তের সৌন্দর্যের জৌলুশ কম। রূপসজ্জার নেই তেমন প্রাচুর্য, আছে মমতাময়ী নারীর এক অনির্বচনীয় কল্যাণী রূপশ্রী। সে আমাদের ঘর সোনার ধানে ভরিয়ে দিয়ে শিশিরের মতো নিঃশব্দ চরণে বিদায় গ্রহণ করে।
হেমন্ত নামটি এসেছে হিম শব্দ থেকে। হেমন্তের নামের মধ্যে লুকিয়ে আছে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বর্ষার শেষ লগ্ন থেকেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা। শরতের নীল আকাশের জুড়ে ভেসে বেড়ায় পেজা তুলার মতো সাদা মেঘ। হেমন্তে সেই সাদামেঘ কমতে থাকে। শরতের শেষের কয়েক পসলা বৃষ্টির পর হেমন্তের সকালে অনুভূত হয় হালকা শীতের আমেজ।
হেমন্ত শিশির ভেজা পায়ে একটু আগেই শরতের দরজায় কড়া নাড়ে। এবার শরৎ বিদায়ের লগ্ন আসে এগিয়ে। শিশির বিছানো, শিউলি ঝরা পথের ওপর দিয়ে কখন নিঃশব্দে চলে যায়। পথে পথে রেখে যায় ম্লান ঝরা শেফালি, বিষণœ কাশের গুচ্ছ আর মাঠভরা নতুন ধানের মঞ্জুরি। সাঁঝের পর হালকা কুয়াশায় জোনাকিরা জোছনা বিলাতে আসে। সেই আলো আঁধারি গায়ে মেখে আসে হেমন্ত।
হেমন্তে পাকে ধান। নদী তীরে নূয়ে পড়ে পয়মন্ত মাটি। বাংলার মুখে তখন মাতৃত্বের মহিমা। ঘাসের বুকে জমে উঠে শিশির। ভোরের বাঁকা রোদে ঘাসের ডগার লেগে থাকা অসংখ্য শিশির কনায় ঝলমল করে লাখো কোটি বাংলাদেশ। হেমন্তের ধানী রঙ, উদাস অন্তরালে যে মাঝি নদী জলে ভাসায় ডিঙি, দূর অচেনা গাঁয়ের না পাওয়া বউটির জন্য গলায় তুলে সুর।
হেমন্ত প্রায় লুপ্ত। তবে এখনো গ্রাম বাংলার বুকে অল্প দিনের জন্য হলেও হেমন্তের আভাস পাওয়া যায়। হেমন্ত ঋতু আপন মহিমায় মহিমান্বিত। তার নিজস্ব স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
বিভিন্ন কারণবশত আধুনিক সভ্যতার যুগে সব জায়গায় সমানভাবে হেমন্তের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হয় না। তবে গ্রামবাংলার বুকে শরতের শেষ পর্ব থেকে হেমন্তের প্রত্যক্ষ অনুভূতি উপলব্ধি হয়।
শরতের উৎসবমুখর সত্তার অবসানে হেমন্তের আগমন অত্যন্ত অনাড়ম্বর ও গাম্ভীর্যপূর্ণ। সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী মানুষের উত্তেজনা ক্ষণিকের স্থিতি দান করতেই প্রকৃতির এমন রূপ। কিন্তু উৎসবের অবসান হেমন্তের এই অনাড়ম্বরতা এবং গাম্ভীর্য তার অবহেলার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাঠেঘাটে ঘাসের ওপর, গাছের পাতায় পড়ে থাকে রূপালি শিশির কণা। সমস্ত শরতের উৎসবের উত্তেজনাকে স্থিমিত করে হেমন্ত যেন প্রকৃতির বুকে একরাশ স্বস্তির নিশ্বাস। হেমন্তের গায়ে কখনো দু-এক পসলা বৃষ্টিও পড়ে। এই বৃষ্টি প্রকৃতপক্ষে শীতের আগমনের পটভূমি রচনা করে। এই সময় এক অপূর্ব মনোরম পরিবেশ বিরাজ করে। যা অত্যন্ত আরামদায়ক।
বাংলার হৃদয় গ্রামবাংলার প্রতিটি ঋতুতেই আলাদারূপে সজ্জিত হয়। গ্রীষ্মে প্রখর, বর্ষায় সে অনন্য, শরতে উৎসবমুখর আর হেমন্তে সে অপরূপা। হেমন্তের প্রকৃত রূপ ডিজিটাল বাংলাদেশে এখনো কিছুটা হলেও প্রত্যক্ষ করা যায় গ্রামবাংলায়।
হেমন্তের শিশির ভেজা ঘাস, শীতের আগে ঝরে যাওয়ার পূর্বে শেষ বারের মতো সজ্জিত হয়ে ওঠা গাছে পাতা হেমন্তকে রানীর মুকুট পড়িয়ে দেয়। তাই তো বলা হয় বসন্ত যদি ঋতুরাজ হয় তাহলে নিশ্চিতভাবে হেমন্ত হলো ঋতুদের রানী।
গ্রামবাংলার বুকে ভোরের হালকা কুয়াশায় ধান গাছের উপর জমে থাকে বিন্দু বিন্দু শিশির কনা মনে হয় সমস্ত গ্রামের পরিবেশকে এক অপরূপ মায়ায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
প্রকৃতির বুকে উৎসবের উত্তেজনা পর স্বস্তির প্রতীক হিসেবে হেমন্তের আগমন হলেও প্রকৃতি এই ঋতুকে প্রাকৃতিক দানের সমারোহ এতটুকু বঞ্চিত করেনি বরং সমগ্র হেমন্তকাল পূর্ণ হয়ে আছে বিভিন্ন রকম ফুল ফল ও ফসলের আড়ম্বরে। শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, ছাতিম, দেবকাঞ্চন, হিমঝুরি, রাজঅশোক ইত্যাদি ফুলের মাধুর্যে হেমন্ত প্রকৃতি মাতোয়ারা হয়ে থাকে। রয়েছে সোনালী ধানক্ষেত। তা ছাড়া কামরাঙা, চালতা, আমলকী, ডালিম ইত্যাদি ফলে ডালি সাজায় হেমন্তে।
হেমন্ত বাংলাদেশের ধান উৎপাদনের ঋতু। হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা। নবান্ন অর্থ-নতুন অন্ন। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্য উৎসব।
হেমন্তে চাষির ঘরে আসে নতুন ধান, আর সেই আনন্দেই গ্রামবাংলা মেতে উঠে নবান্ন উৎসবে। ঘরে ঘরে শুরু হয় পিঠা পুলির আয়োজন।
বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ফসল ঘরে তোলার পর পরদিনই নতুন ধানের নতুন চালে ফিরনি-পায়েস, পিঠা-পুলি তৈরি করে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। নবান্নে জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়। মেয়েকে বাপের বাড়িতে নাইওর আনা হয়।
নবান্নে নানা ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান-বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন করা হয়। লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শাখের চুড়ি, খৈ মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্যমেলায়।
হেমন্ত ঋতুর শান্ত প্রকৃতি অনেক কবি সাহিত্যক নানাভাবে তুলে ধরেছেন তাদের রচনায়। তাদের কাছে হেমন্ত হল কাব্যকে নতুন করে উদযাপনের ঋতু। উনিশ শতকের প্রথম পর্ব থেকে আজ পর্যন্ত কাব্যচর্চায় হেমন্তের প্রভাব প্রকট।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
হায় হেমন্তলক্ষী তোমার নয়ন কেন ঢাকা
হিমের ঘন ঘুমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা।
সন্ধ্যা প্রদীপ তোমার হাতে
মলিন হেরি কুয়াশাতে
কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা।
ধরার আগল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।
সুফিয়া কামাল লিখেছেন-
সবুজ পাতার খামের ভিতর / হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে / কোন পাহাড়ের উপর থেকে / আনল ডেকে হেমন্তকে।
হেমন্ত আমাদের দু’হাত ভরে শুধু দিয়েই যায়। রূপসী হেমন্ত ধূসর কুয়াশায় নয়ন ঢেকে ফসল ফলাবার সাধনায় থাকে নিমগ্ন। আজও তিস্তা-করতোয়া থেকে শুরু করে পদ্মা যমুনার তীরে তীরে যেসব সোনালী ফসল সোনা ছড়ায় সেও হেমন্তেরই দিনে। হেমন্তে ফুলের ততটা বাহার নেই। নেই কোনো জৌলুশ। রূপ সজ্জারও নেই প্রাচুর্য। আছে মমতাময়ী নারীর এক অনির্বচনীয় কল্যাণী রূপশ্রী। সে আমাদের ঘর সোনার ধানে ভরিয়ে দিয়ে শিশিরের মতো নিঃশব্দ চরণে বিদায় গ্রহণ করে।
হেমন্তে ঘরে ঘরে সোনার ফসল ওঠে। ধান ভানার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে। ঢেকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। নবান্ন আর পিঠে উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। সবার সোনালি রোদে সোনালি ধান ঝলমল করে হেসে ওঠে। তাই ধূসর রঙের হেমন্তে আছে পরিপূর্ণতা, রিক্ততার লেশমাত্র তাতে নেই। আর এই দান কুয়াশা আর বিষণ্নতার পোশাক পরা শান্ত সৌম্ম হেমন্তের।
হেমন্তের উচ্ছ্বাস নেই, চপলতা নেই। সে যতটা পারে কেবল দিয়েই যায়। ধরিত্রীর অন্তরঙ্গ সহচরী হেমন্তের তাই নিজের কোনো প্রত্যাশা নেই। দানেই তার আনন্দ।


আরো সংবাদ



premium cement
ফরিদপুরের গণপিটুনিতে নিহত ২ নির্মাণশ্রমিক জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনি সদস্যপদ লাভের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান

সকল