১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শরতের মুগ্ধতায় রূপসী বাংলাদেশ মিলন সব্যসাচী

শরতের মুগ্ধতায় রূপসী বাংলাদেশ মিলন সব্যসাচী -

পৃথিবীর প্রতিটি দেশে ঋতুবৈচিত্র্যের অভিন্ন বৈশিষ্ট বিরাজমান থাকলেও বাংলাদেশের শরৎ ঋতু বিরল ও ব্যতিক্রম। অন্যান্য দেশে যেমন- গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত ঋতুর আদি অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেলেও সব দেশে নির্দিষ্টভাবে শরতের দেখা পাওয়া দুঃসাধ্য। বিশেষ করে বাংলার অনাবাদি মাঠে, নদ-নদীর তীরে, বালুচরে কাশফুলের শুভ্রতায় শরৎ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। শরৎ প্রকৃতি প্রেমিক মানুষ ও সুশীলসমাজকেও আপন রূপের মাধুর্যে প্রভাবিত করে। সুনীল আকাশে শুভ্র-মেঘের ভেলায় ভেসে ভাবুক মন হয়ে ওঠে উদাসী বাউল। শিশিরে সিক্ত শিউলি, বকুল, বেলি, জুঁই, চামেলি, হাসনাহেনার মিষ্টি সুবাসে শরৎ প্রভাতে অনাবিল আনন্দে নেচে ওঠে প্রকৃতির প্রাণ। শারদীয় প্রভাতের স্নিগ্ধ ও মনোমুগ্ধ রূপ, রস মানবচিত্তে গভীর রহস্য সৃষ্টি করে। শিশির স্নানে প্রকৃতি ও মানুষের মন সুচি শুদ্ধ হয়ে ওঠে। শরৎ যেন তার স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় এক আলোকিত ভুবনে সবাইকে উদাত্ত আহ্বান জানায়। শরতের আগমন বার্তা প্রকাশ পায় ভাদ্র মাসে। আর বিদায় ঘণ্টা বেজে ওঠে আশ্বিন মাসের শেষান্তে। ভাদ্রের মাঝামাঝি সময়েও থেকে যায় বর্ষা বিদায়ের রেশ। তবে বর্ষণ মুখরিত বর্ষার অবিরল ধারাপাত ক্রমেই শিথিল হয়ে আসে। বাতাসের প্রবহমানতায় দিক-দিগন্তের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। উত্তর-পশ্চিম থেকে প্রবহমান বাতাসে তাপমাত্রার আধিক্য খানিকটা কমে যায়। শরতের আসল রূপ, রস, বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে আশ্বিন মাসে। তখন সুনীলাকাশে শুভ্র-মেঘ বালিকারা স্বপ্নের ডানা মেলে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে কোলাহল করে। প্রভাতে ঘুম ভাঙলেই দু’চোখের দৃষ্টি কেড়ে নেয় সবুজ দূর্বাঘাসের ডগায় মুক্তার মতো জ্বলে ওঠা শিশির বিন্দু। শরতের স্নিগ্ধ সকালের সাথে কোনো ঋতুর কোনো সকালের তুলনা হয় না। পল্লীর মেঠোপথে শিশির ভেজা পায়ে শরৎরানী ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসে।


পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে অপরূপ শরতের রূপের পশরা সাজায় কিনা কে জানে! রূপসী বাংলার শরৎ চিরকাল তুলনাহীন। শরতেই ফোটে লাল ও নীল পদ্ম। ঝিলের জলে পদ্ম-পাতায় সকালের সোনারোদ পোহায় জলজ গোখর। সাপ ও ভোমরের খেলায় অপরূপ মায়াবী মুগ্ধতায় হাতছানি। পদ্মের ওপর শিশির বিন্দু ও রোদের কোমল-রশ্মি সৃজন করে আদর আর মোহময় মুগ্ধতার যুগপৎ। অবারিত মাঠের শেষান্তে কিংবা নদ-নদীর তীরে ফুটে থাকা কাশবনে শারদীয় সকাল বুলিয়ে দেয় তার অনুপম সোহাগ। বাউল বাতাসে দুলে ওঠে কাশবনের ষোড়শী শরৎ। প্রেমময় প্রকৃতির হৃদয়ে অপ্রতিরোধ্য শিহরণ তোলে বঙ্গকন্যা শরৎ। ঋতু বৈচিত্র্যের নান্দনিকতায় ধন্য দেশ রূপসী বাংলা। শিউলি ফুলের শরৎ আর শরতের শিউলি দুইয়ের মাঝে রয়েছে এক সুনিবিড় ও সুমধুর প্রাকৃতিক সম্পর্ক। অনিন্দ্য সুন্দর শরতের স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ মুখর হয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতার ভাষায় শরৎ সকালকে আহ্বান করেছেন এভাবে- ‘আজিকে তোমার মধুর মূর্তি/হেরিনু শারদ প্রভাতে/ হে মাতঃ বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ/ জলিছে অমল শোভাতে।/ পারে না বহিতে নদী জলভার/ মাঠে মাঠে ধান ধরে না ক আর/ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল/তোমার কানন সভাতে,/মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী/শরৎকালের প্রভাতে।’ অবারিত সবুজের মাঠে দুলে ওঠা সবুজের ঢেউয়ে ক্রমাগত বেড়ে ওঠা কচিকাঁচা ধানের চারার স্নিগ্ধ সবুজের ওপর সকালের রক্তিম রবি যখন শেকড় স্পর্শী চুম্বনে আদর সোহাগ জানায়। সে দৃশ্য বর্ণনাতীত বটে। কেবল ইন্দ্রিয় দ্বারাই তা উপলব্ধি করা যায়। কবির অনুভব শক্তি, কল্পনা শক্তি, চিত্রকল্প নির্মাণ শক্তি অসাধারণ এবং অনন্য। সাধারণ মানুষের যা নেই। বর্ষার বেদনাবিধুর নিঃসঙ্গতা শেষে প্রসন্ন হাসি নিয়ে নিভৃতে নীরবে আসে শরৎ। যখন তখন মেতে ওঠে মেঘ রৌদ্দুরের লুকোচুরি খেলায়। শরৎকালে বন-বনান্তরে ফোটে শিউলি, বকুল, গোলাপ, মাধবি, মল্লিকা, কামিনী প্রভৃতি ফুল। হাওর, বাঁওড়, ঝিলের জলে ফোটে শাপলা আর নদীর তীরে বকসাদা কাশফুল। বৃক্ষশাখে থাকে সুবজ পল্লবের সমাহার। নদী সরসীর বুকে কুমুদ কলমের নয়ন-মুগ্ধকর সমারোহ শোভা পায়। প্রাঙ্গণে প্রাঙ্গণে শেফালি-সৌরভ, আঙিনায় আঙিনায় গুচ্ছ-গুচ্ছ দোপাটির বর্ণসন্ধ্যা। শরতের সৌন্দর্য সত্যি অতুলনীয়। ছুটির ঋতু শরৎ। শরতের অপরূপ রূপ বৈভবের মাঝেও বাঙালির প্রাণে বেজে ওঠে ছুটির ঘণ্টা। আকাশে বাতাসে তার উদয় মুক্তির আহ্বান। অবকাশের ঋতু শরৎ বাঙালির মন-প্রাণকে করেছে সৌন্দর্যের তীর্থাভিমুখী। শরৎ কিন্তু ফসলের ঋতু নয়, অথচ বর্ষায় যে বীজ বপন করে, হেমন্তের যে পাকা ধানের পরিণতি-প্রতিশ্রুতি শরতে তারই পরিচর্যা। অনাগত দিবসের স্বপ্ন সাধনা তার নরম নেত্রে খুশির তুফান তোলে। বাঙালির জাতীয় উৎসবকে স্মরণীয় বরণীয় করে তোলার প্রয়াসে বাঙালি কবি সাহিত্যিকের দল তাদের কাব্য ও প্রবন্ধ রচনাসম্ভার পরিপূর্ণ করে তোলেন সংবাদ সাময়িকীর শারদ সংখ্যাগুলোতে। অত্যন্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে পাঠকদের দৃষ্টিতে তুলে ধরেন তাদের কালজয়ী সৃষ্টিসম্ভার। তাদের নিত্যনতুন সাহিত্য ভাবনার নির্যাস পাঠকমন সিক্ত করে। শরতেই প্রকাশ পায় রূপে রসে রঙে বৈচিত্র্যে মাখামাখি শারদীয় সংখ্যাগুলো। এর মধ্যে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে প্রকাশিত পূর্জা সংখ্যাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শরৎ ঋতুর অনুপম সৌন্দর্যে বিমোহিত কবি প্রাণের উপলব্ধি অন্য রকম ও অসাধারণ।


কবিরা অন্তর চোখের দৃষ্টি দিয়ে সুশোভিত পৃথিবীর পরতে পরতে লুকায়িত সুপ্ত সৌন্দর্যকেও দেখতে পান। শরৎকালে বাংলাদেশের যে রূপ-ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্য পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে তা অন্য কোনো ঋতুতে পরিলক্ষিত হয় না। শারদ শশীর দুধ জোস্নায় প্লাবিত রাত্রিকালীন পথে ঘাটে ফুটে ওঠে শরতের মায়াবীরূপ। বাংলার কাশবন, কৃষ্ণচূড়া ও নদীর নির্জন বুকে স্নিগ্ধময়ী জলতরঙ্গের মৃদু প্রবহমানতা। শরৎকালের জোস্নাস্নাত রাতে নিভৃত পল্লীর নর-নারীরা গানের মধ্যে বিভোর থাকে। পথকবিরা, শিল্পীরা, অভিনেতারা যাত্রা, কবিগান, ইত্যাদি পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় আসর জমায়। শাখা-প্রশাখায় ফুটে থাকা শিউলি সৌরভ, নীলাভ নীলিমার অপরূপ সৌন্দর্য মানবমনে প্রশান্তির ঝড় তুলে যায়। আসন্ন প্রভাতকে সু-স্বাগত জানাতে ঝরে পড়ে রাতের শিউলি। শরতের শুভ্র-স্নিগ্ধতায় রূপসী বাংলার বন-উপবন, দোয়েল, কোয়েল ময়নার কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। শরতের সৌন্দর্যমণ্ডিত পটভূমিকায় শস্য বিচিত্র ধরণীর মনোলোভা রূপলাবণ্য, নদ-নদীর উচ্ছল তরঙ্গে ভাসমান নৌকার রঙিন পাল, শ্বেত-শুভ্র জোস্নার পুলকিত সমারোহ বাংলাদেশকে সৌন্দর্যের অমরাবতীতে পরিণত করে। শরৎ ও হেমন্ত এই দু’টি ঋতুর সংযোগ সেতুতে দাঁড়িয়ে শরতের অমলীন প্রতিশ্রুতি মূলত সোনালি ফসল কাটার আগমনী গান গায়। শরৎ বহন করে নিয়ে আসে সোনা বরণ ধান কাটার অর্থাৎ ফসলের সম্ভাবনা বাণী। ফসলপ্রত্যাশী কিষান ও কাজল বধূদের অন্তরে বইয়ে দেয় অনবদ্য আনন্দের বন্যা। সেই আনন্দ বর্ণাঢ্য মিছিলে পরিণত হয় ।
প্রকৃতি এখন ঋতুরাণী শরতের মায়াবী মুগ্ধতায় মগ্ন। অসীম আকাশে দৃষ্টির সীমানাজুড়ে শরতের লীলাখেলা। শরৎ মানেই নীল নীলিমায় বকসাদা মেঘের ভেলা। নীলিমার প্রশস্ত বুকজুড়ে শিমুল তুলার মতো মেঘের উড়াউড়ি আর পাগলা হাওয়ার তোড়ে মেঘবালিকাদের কানামাছি খেলার অনাবিল আনন্দ। নদীর পাড়ে কাশফুলের মেলায় প্রকৃতির মহোৎসব। সোনারঙে রঙিন হয়ে ওঠা সুসজ্জিত গোধূলিবেলা। মেঘের বাড়ি মেঘে মেঘে মিতালী। শারদীয় পুষ্পের সুমিষ্টি সুবাসে সুবাসিত দশদিক। শরৎ প্রকৃতির মোহনীয় মুগ্ধতায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিমোহীত হয়ে স্বরচিত গানে হয়তো মনের অজান্তেই গুণগুণ সুরে গেয়ে উঠেছেন- ‘শরতে আজ কোন অতিথি এলো প্রাণের দ্বারে। আনন্দে গান গা রে হৃদয় আনন্দে গান গা রে।’


বহুমাত্রিক সাজে শরতের প্রকৃতি সাজে, শরতের প্রকৃতি যখন এত রঙে সেজে ওঠে তখন আর নিজেকে নিরানন্দের জালে জড়িয়ে রাখা যায় না, বড় সাধ জাগে প্রকৃতির সাথে একাকার হয়ে যেতে। একটুকরো অবসরে মনটাও সেজে ওঠে শরতের সাজে। তাই শরৎকালীন সময়ে প্রকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে পরিধান করা যায় নানা রঙের পোশাক। শরতকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে শারদীয় পোশাক শিল্প-কারখানা, দোকান ও শপিংমল ইত্যাদি। শারদীয় উৎসবে নীল-সাদা-সবুজ রঙে রাঙানো যায় এই মন। হলুদ, বেগুনি, ধূসর কমলা রঙের মিশিলের পোশাকেও সবাইকে বেশ মানায়। এমন শরতকে উপলক্ষ করে শরতমুখী বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজগুলোতে খুব সহজেই পাওয়া যায় শারদীয় পোশাক। ব্যবসায়ী দৃষ্টিকোণ থেকে শরতের থিমকে অবলম্বন করে নানা প্রকারের পোশাক তৈরি করছে ব্যবসায়ীরা। তারা সাজিয়ে রেখেছে বাহারি রকম শাড়ি। হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রেখেছে শারদীয় পাঞ্জাবি। এ সময়ে শরৎ শাড়ির আঁচলে একমুঠো নীলাকাশ হয়ে দোলা দেয় মনে। কখনো কখনো আবার শরতের কাশবন উঁকিঝুঁকি দিয়ে যায় পাঞ্জাবি কিংবা কামিজের ভাঁজে ভাঁজে। নৌকা, নদী, শাপলা, কাশফুল, মাধুরী, মল্লিকা ও গোধূলি প্রকৃতির এমন অনেক দৃশ্য ধরা দেয় কুর্তি-পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজসহ বিভিন্ন রকমের পোশাকে। এ ধরনের বেশির ভাগ পোশাকেই থাকছে হ্যান্ড পেইন্ট স্ক্রিন পেইন্ট ও ব্রাশ পেইন্ট ইত্যাদি। এ ছাড়া মেশিন, অ্যাম্ব্রয়ডারি, হাতের কাজ, ডিজিটাল প্রিন্টও ভালো লাগবে। নারীদের নানা রকম পোশাকের আবেদনের মধ্যে শাড়ির আবেদনই সর্বপ্রথম স্থান পায়। এ সময়ে এ প্রজন্মের তন্বী-তরুণীরা শখের বশেও অনেকে শাড়ি পরতে পছন্দ করেন। শরৎ মানেই বকসাদা কিংবা দুধসাদা শুভ্রতা আর স্নিগ্ধতার কোমল পরশ। বিশেষ করে শরৎ ঋতুতে স্নিগ্ধ সাজের কোনো বিকল্প নেই। শহরমুখী মানুষ বহুমাত্রিক ব্যস্ততা নিয়ন্ত্রণে রেখে ছুটির দিনে ঘুরে আসতে পারেন নিকটবর্তী কোনো এক নদ-নদীর তীরে। যেখানে মাথার ওপর সুনীল আকাশ, দৃষ্টির সীমানায় হাতছানি দিয়ে কেবলই কাছে ডাকে শরতের শুভ্র-স্নিগ্ধ কাশবন। এ সময়ে দিগন্তজোড়া অবারিত মাঠের মিতালি খুব সহজে উপভোগ করা যায়। যা কখনো ইট-পাথরের শহরে বসে উপভোগ করা সম্ভব নয়। উপলব্ধি আর উপভোগের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। স্বপ্ন নয় সত্যি ঝিরিঝিরি হাওয়ায় শুভ্র-শাড়ির আঁচল উড়িয়ে এখন শরতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবিকণ্ঠে অনন্ত একবার বলুন- ‘শরতের মায়াবী মুগ্ধতায় বিমোহীত রূপসী বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’


এখন মেঘমুক্ত আকাশ থেকে যেনো শরতের শুভ্রতা ঝরে। শিউলি তলায় দূর্বাঘাসের ওপরে হিমেল হাওয়ায় ঝরে পড়া শিউলির স্তূপ সাদা চাদরের মতো মনে হয়। গাছে গাছে বকুল, বেলী, জুঁই, চামেলি, হাসনাহেনা, শেফালি, মালতি, টগর। বিলে ঝিলে ফুটন্ত শাপলা ফুলের অফুরন্ত সমাহার। শরতের মেঘমুক্ত আকাশে যেন অপার্থিব স্বপ্নের ফুলঝুড়ি। শরৎ সকালে কিশোর-কিশোরীরা, দুষ্ট-দলের শিরোমণিরা দল বেঁধে ছুটে যায় শিউলি তলায়। তারা ফুল কুড়িয়ে কেউ কেউ মালা গাঁথে। শরৎ শহরমুখী দরিদ্র পরিবারের জন্য ঋতুভিত্তিক আশীর্বাদও বটে। অনেকেই আছে যারা রমনা পার্কে গিয়ে ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে বিক্রি করে অতঃপর সঞ্চিত অর্থে রুটি রোজগারের ব্যবস্থা হয়। শরতে গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে নদ-নদী, খাল-বিলে জমে ওঠে নৌকা ভ্রমণের মহোৎসব। এঁকেবেঁকে বয়ে চলা নদীর বুকে ডিঙি নাও, পানসী নাও কিংবা ময়ূরপঙ্খী নাও বেয়ে বেয়ে আনকোড়া মাল্লা-মাঝিরাও মনের অজান্তে গেয়ে ওঠেন ‘মন-মাঝি তোর বৈঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না।’ এছাড়াও জারি-সারি, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি গান গেয়ে তারা অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠে। বিলের কাকচক্ষু জলে ফুটে থাকে লাল, নীলপদ্ম আর শুভ্র হাসির শাপলা-শতদল। সকালের হালকা কুয়াশায় সেই শাপলাগুলো এক স্বপ্নীল দৃশ্যের আভাস বয়ে আনে। আলো চিকচিক বিলের স্বচ্ছজলে ফুটে ওঠে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য লীলা।


পুকুর পাড়ে গাছের মগডালে অথবা কঞ্চিতে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকে মাছরাঙা, হঠাৎ করে উড়াল দিয়ে ধারাল ঠোঁটের ভাঁজে ধরে নিয়ে যায় পুঁটি, মলা, ছোট ছোট মাছগুলো। চান্দা, খলসে ও ছোট প্রজাতির মাছ জলের উপরি ভাগে ভেসে উঠলেই মাছরাঙা ছোঁ মেরে ধরে নিয়ে যায় লম্বা ঠোঁটে করে তার পর বৃক্ষশাখে বসে শেষ করে অনেক স্বাদের আহার পর্ব। এভাবে সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে গোধূলিবেলা অতঃপর সমস্ত দিনের শেষে নিঝুম সন্ধ্যায় পাখিরা আপন নীড়ে ফিরে যায়। রাতের গভীরে ক্রমাগত থেমে যায় ব্যস্ত পৃথিবীর সব কোলাহল। দূর গ্রামগুলো থেকে থেমে থেমে ভেসে আসে ঢাকের শব্দ। শরতের সুনীল আকাশ, শান্ত বাতাস, সবুজ প্রকৃতি, শরতের নদী, শরতের শিউলি-শেফালি ফুল সব কিছুতেই এক মায়াবী মুগ্ধতা। শরতের শুভ্র স্নিগ্ধতা পবিত্রতারই প্রতীক। সত্যি বিচিত্র রূপ নিয়ে শরৎ আসে আমাদের চেতনায় ধরা দিতে। শরতে বিচিত্র ফুলের সমাহার থাকলেও শিউলি ফুল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিউলির আরেক নাম শেফালি, শিউলি বা শেফালি যে যে নামেই ডাকি না কেনো চমৎকার এই ফুল নিয়ে গ্রিক ও ভারতীয় দু’টি উপকথা আছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে শিউলির বিশাল বন ও তার তীব্র-ঘ্রাণের প্রশংসা করেছে। রবি, নজরুল, জীবনানন্দ সবাই শিউলির গুণ-কীর্তনে মুগ্ধ মুখোর। সাঁঝের মায়ায় শিউলিকলি চোখ তুলে চায়। সূর্যের সাথে এদের ভীষণ আড়ি। রাত পোহালেই মাটিতে ঝরে পড়ে। এ ফুলের বোটার হলুদাভ রঙ অনেক দিন টিকে থাকে। অন্য দিকে কোনো সুবাস নেই কাশফুলের অথচ কাশফুল না ফোটলে মনেই হয় না শরৎ এসেছে। মূলত কাশফুলের সৌন্দর্য, আকাশের শুভ্রমেঘ আর শিউলির সুগন্ধই শরতের সৌন্দর্যকে পরিপূর্ণ করে তোলে। কাশফুলের সাদা ঢেউ-ই শরতের প্রধান বৈশিষ্ট্য। উৎসবের ঋতু শরৎ।


নগরের কোথাও কী কাশবন, শিউলিতলা আছে? বনসাইবৃক্ষ কিংবা প্লাস্টিকের বৃক্ষে সুসজ্জিত কৃত্রিম কোনো ঋতুতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুতরং পার্থিব সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে হলে প্রকৃতির প্রতি মানুষকে আরো আন্তরিক এবং অনেক যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সার্বিক আয়োজনের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে সরকারসহ সচেতন মানুষ, সব সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষের নিবিড় প্রকৃতি পরিচর্যাও প্রয়োজন। শরতের নিস্তব্ধতা গ্রাম বাংলার দিগন্ত রেখার নিচে ঘূর্ণায়মান সন্ধ্যার মতোই শান্ত ও সুমধুর। অদূর ভবিষ্যতে কেবল প্রকৃতি নির্ভরশীল ঋতু বৈচিত্র্যের বহুমাত্রিক সৌন্দর্য প্রত্যাশা করলেই চলবে না। প্রকৃতিকে রক্ষণাবেক্ষণ এখন সময়ের দাবি। শুধু কল্পনায় নয়, আসুন আগামী প্রজন্মের জন্য সুকান্তের বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে সকলে সম্মিলিতভাবে দূরদর্শী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করি। প্রকৃতিবান্ধব পরিবেশের জন্য সবার সুন্দর উদ্যোগে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগ, অর্থায়ন, আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা। যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর স্বপ্ন-বাস্তবায়নে আন্তরিকভাকে পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে হাজার বছরের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করেছেন। পদ্মা নদীর তীরেও সরকারিভাবে গড়ে তোলা সম্ভব পরিবেশবান্ধব শরৎ ঋতুর স্বদেশ। জয় হোক শুভ্র শরৎসহ ষড়ঋতুর রূপে বিমোহিত রূপসী বাংলার।

 


আরো সংবাদ



premium cement