২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

শিউলিতলা

শিউলিতলা -

কাশফুল দোলানো বিকেলে, শিউলি তলায় দাঁড়িয়ে শিউলি শুভ্র সুনীল আকাশের সাদা মেঘমালার লুকোচুরি খেলা দেখছে আনমনে। এই মধ্য বয়সে জীবনের কত স্মৃতি জমা হয়েছে তার স্মৃতির ভাণ্ডারে। আজকের আকাশের সাদা মেঘের সাথে সেই স্মৃতির বড় মিল।
হ্যাঁ সেসব স্মৃতির সাক্ষী এই শিউলি ফুল গাছটি। শিউলির যে দিন জন্ম হয় সে দিন তার বাবা রফিক উদ্দিন তার জন্য একটি শিউলি ফুল গাছের ছোট্ট চারা কিনে এনেছিলেন। চারাটি এনে শিউলির মা সুরাইয়াকে বলেছিলেন- আমার মেয়ের নাম রাখলাম শিউলি। ওর জন্য একটি শিউলি ফুল গাছ নিয়ে এসেছি। আমার মেয়ে ধীরে ধীরে বড় হবে আর এই ছোট্ট গাছটিও বেড়ে উঠবে ওর সাথে সাথে। শিউলি যখন একটু বুঝবে, সেদিন শিউলি গাছটির সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দেবো।
ছোট্ট শিউলি ধীরে ধীরে বড় হলো, শিউলি ফুল গাছটিও বড় হলো। ছোটবেলা থেকেই গাছটির সাথে শিউলির সখ্য। ছোট শিউলি তার ছোট হাতে শিউলি ফুল গাছটির যত্ন করেছে। একসময় গাছটি শাখা-প্রশাখায় ভরে উঠল। সেই শাখা বিস্তার করে শিউলির মাথার ওপরে উঠে গেল। শিউলি গাছটির পাতা শাখা-প্রশাখা কিছুই আর ছুঁতে পারে না। খুব মন খারাপ হয় তার। এক শরতের সকালে সে শিউলিতলায় গিয়ে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই ওর মাথার উপরে একটি শিউলি ফুল ঝরে পড়ে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে ছুটে যায় বাবার কাছে। বলে বাবা, ও আমায় ভোলেনি। এই দেখো কী সুন্দর ফুল।
রফিক উদ্দিন খুশি হয়ে বললেন, দেরিতে হলেও গাছে ফুল ধরেছে। চল মা আমরা শিউলিতলায় যাই। দেখি আরো ফুল দেখতে পাই কি না।
দু’জন শিউলিতলায় গিয়ে দেখে গাছে আরো দু-চারটি ফুল দেখা যাচ্ছে। মাটিতে পড়ে আছে বেশ কিছু ফুল। রফিক উদ্দিন খুশি হয়ে বলেন, দাঁড়া মা, আমি তোর মাকে নিয়ে আসি তিনজন মিলে আনন্দ করে শিউলি ফুল কুড়াব। সুন্দর গোলাপি রঙের ঝুড়িতে কমলা রঙের বিন্তে সাদা শিউলি ফুলগুলো চমৎকার লাগছিল। সেদিন রফিক উদ্দিন সুরাইয়াকে বললেন, আজ আমার মেয়ের গাছে প্রথম ফুল ফুটেছে। তাই খাবার প্রতিদিনের মতো মাছের ঝোল শাক ডাল এসব হলে চলবে না। আজ বিশেষ কিছু চাই। আজ চালের রুটির সাথে হাঁসের গোশত আর পায়েশ খাবো।
দিন যেতে যেতে বড় হলো শিউলি। এক শরতের সকালে নব যৌবনা শিউলির মনে দোল দিয়ে গেল শিউলি ফুলের সাদা পাপড়ি, আকাশের সাদা মেঘ, কাশফুল দোলানো বাতাস। সে দিন রফিক উদ্দিনের বন্ধুর ছেলে শাউন এসেছিল ওদের বাড়িতে। শিউলির সাথে আলাপ পরিচয় হলো। শাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক। শিউলি গ্রামের কলেজের বাংলা সাহিত্যের তৃতীয়বর্ষের ছাত্রী। শিউলিতলায় রফিক উদ্দিন সুন্দর বসার জায়গা বানিয়ে দিয়েছেন। শিউলি আর শাউন সেখানে বসে গল্প করছিল। একসময় শিউলি জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা আপনার কোন ঋতু পছন্দ?


শাউন বলে- শরৎ ঋতু।
-কেন? বিশেষ কোনো কারণ আছে কি?
-শরতের মেঘমুক্ত আকাশের সুনীল রূপকান্তি আলো ছায়ার লুকোচুরি, শিউলি ফুলের মন উদাস করা গন্ধ, নদী তীরের কাশফুল, নতুন প্রভাতের নবশিশিরের আলপনা, শুভ্র জোছনা, পুলকিত রাত্রি আমার খুব ভালো লাগে। আর আপনার?
- আমার ভালো লাগে শাউন, বর্ষা। তবে শরৎ আমার জীবনে একটি বিশেষ ঋতু। শরতে আমার শিউলিতলা ভরে থাকে শিউলি ফুলে।
- শাউন আপনার পছন্দ তা হলে শাউনের কথা শুনতে পারি?
- এখন শরৎ বেলা তাই শাউনের কথা থাক। একদিন শাউন আর আপনি একসাথে আসবেন, সেদিন বলব।
- আচ্ছা শরতের কথাই হোক।
- আপনিই বলুন।
- শিউলিতলায় শিউলি বালা।
খোঁপায় যে তার শিউলি মালা।
- দারুণ বলেছেন। আসলে এই শিউলি গাছের সাথে ছোটবেলা থেকেই আমার সখ্য। আমি আর বাবা কত সময় কাটিয়েছি এই শিউলিতলায়। দু’জন একসাথে বসে মালা গেঁথেছি। বাবাই আমাকে মালা গাঁথা শিখিয়েছিলেন ছোট্টবেলায়। এই গাছ আর এই গাছতলা আমার জীবনের অনেক বড়।
কেটে গেল আর কিছু দিন। শাউন আর শিউলির বিয়ে হলো। কিন্তু শিউলি এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। শিউলিতলায় দিনে কয়েকবার না গেলে তার চলে না। এই শিউলি ফুল গাছ ছেড়ে কোথাও যাবে না সে। সে দিন শাউন শিউলির আবেগের মূল্য দিয়েছিল। তার মা বাবা ভাই বোন কিছুই ছিল না। তার কোনো পিছুটান ছিল না। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে গ্রামের কলেজে জয়েন করে।
খুব সুন্দরভাবে চলছিল তার সুখী জীবন। এর মধ্যে শিউলির কোলজুড়ে আসে শ্রাবণ। ফুটফুটে ছেলেটিকে নিয়ে দু’জনের কত স্বপ্ন ছিল।
সময় অপেক্ষা করে না। সে যে গতিময়। তাই তো পার হলো অনেকটা সময়। আজো বেঁচে আছে শিউলি ফুলগাছটি। বেঁচে আছে শিউলি। এই শিউলিতলার সাথি বাবা নেই মা নেই। ভালোবাসার শাউনও নেই। তার সাথে কত স্মৃতি শিউলিতলায়। তিন বছর আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল।
শ্রাবণ পড়াশোনার জন্য ইউরোপ কান্ট্রিতে গিয়েছিল। ওখানেই ঘর বেঁধেছে। মাকে ওখানে নিতে চেয়েছিল। শিউলি তার শিউলিতলা ছেড়ে কোথাও যায়নি। সবাই ছেড়ে গেছে কিন্তু শিউলি ফুলগাছটি তাকে ছেড়ে যায়নি। এই শিউলিতলায় বাবা, মা, স্বামী ও আদরের শ্রাবণের অনেক স্মৃতি আছে। আজ শিউলিতলা আর সেই স্মৃতির চারণভূমিতে হেঁটে হেঁটে দিন কাটে শিউলির। শিউলি গাছ আর শিউলি এক অদৃশ্য বন্ধনে দু’জন বাঁধা পড়ে আছে।
ভাবতে ভাবতে একসময় কানে এলো- আপা চলেন অনেক ব্যালা অইছে। নাশতা খাইতে অইব না। ভোর বেলায় আইছেন শিউলিতলায়। কত বেলা অইছে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল