২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অসাধারণ এক গ্রন্থের কথা বলি

-

কবি আবদুল শিকদারের কাব্যসাধনা লইয়া পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব শব্দের জাদুকর সালেহ মাহমুদ রিয়াদ রচিত গ্রন্থখানি পাঠ করিয়া অতীব মুগ্ধ ও বিস্মিত হইলাম। ইহার শিরোনাম প্রদান করা হইয়াছে ‘আবদুল হাই শিকদারের কবিতা- বিশ্ববীক্ষার অপরাজেয় প্রতিভূ’। গ্রন্থখানির ভূমিকা রচনায় লেখক তাহার মুন্সিয়ানার চরম উৎকর্ষ সাধন করিয়াছেন বলিয়া প্রতীয়মান হয়। ইহাতে প্রথম মহাকাব্য গিলগামেশ অবতারণার মধ্য দিয়া তিনি যেমন দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছেন যে গিলগামেশ তার বন্ধু এনকিদুর প্রাণরক্ষায় পৃথিবীর একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত চষিয়া বেড়াইয়াছেন এমনকি সমুদ্রতলদেশ হইতে জীয়নলতা তুলিয়া আনিয়াও শেষ রক্ষা করিতে পারিলেন না। মহানায়ক গিলগামেশ যেইখানে প্রাণের প্রস্থান রহিত করিবার প্রতিজ্ঞায় রত আবদুল হাই শিকদার সেইখানে প্রতিষ্ঠা করিবেন সর্বপ্রাণবাদের প্রকোষ্ঠহীন প্রাসাদের অগুনিত স্তম্ভ-যেইখােেন দেশ-কাল-ধর্ম-আদর্শ কোনো গৃহীত উপাদান হইবার অধিকার অর্জন করে না, সেইখানে প্রস্তর হইতে স্পন্দনশীল সকল জড় ও জীবের জন্য কবির উদ্বেলিত উপাসনা- তিনি গোত্রহীন হইবেন; তিনি বহির্গত হইবেন ধর্ম ও বিশ্বাসের অবসন্ন দেহভার হইতে, চলিতে থাকিবেন গিলগামেশের পদচ্ছাপ ধরিয়া সকল মৃত্যু ও যন্ত্রণার অবৈধ হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। তিনি বলিবেন-
‘সুকল্যানের আজান জাগাও,শঙ্খধ্বনি মর্মে,
টিকি-দাড়ি নয়, সঁপে দাও প্রাণ সত্য মানবধর্মে।
গির্জা ঘণ্টা, প্যাগোডা শিক্ষা নামুক ফলিত কর্মে,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, টিপসহি দাও ফর্মে।’
মহাকবি হোমার, জন মিল্টন, টি এস এলিয়ট, গেটে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিশ্বখ্যাত সব মহাকবিদের প্রসঙ্গ টানিয়া তাহাদের কাব্য উদ্ধৃত করিয়া প্রমাণ করিয়াছেন তাহাদের সীমাবদ্ধতার কথা। কিন্তু ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ যিনি সকল সীমাবদ্ধতার ঊর্র্ধ্বে গমন করিয়া তুলিয়া আনিয়াছেন হাজারো মুক্তিকামী ফিলিস্তিনির হৃদয় নিংড়ানো আবেগ। তার কবিতার একেকটি লাইন যেন দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইস্পাতদৃঢ় প্রাচীর। যিনি বিশ্বদরবারে তুলিয়া ধরিয়াছেন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ কিছু মুক্তিকামী মানুষের অসহায় আর্তনাদ। তাহার কবিতায় একদিকে যেমন ইহুদি হানাদার জল্লাদদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ফিলিস্তিন যোদ্ধাদের দুর্বার লড়াই অনুপ্রাণিত হয় অপর দিকে, আন্তর্জাতিক মোড়লদের দুরভিসন্ধিমূলক নির্লিপ্ততা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যাত হয়। আবদুল হাই শিকদারের কবিতা অনুরূপ সামাজিক, মানবিক, দেশপ্রেম, মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠ উচ্চকিত করিবার সংগ্রাম উৎসাহিত করে। তিনি বিশ্বের বঞ্চিত মানুষের ক্রন্দনের কারণ সন্ধান করিয়াই কর্তব্য সাধন করেন নাই, ইহার প্রতিকারও চাহিয়াছেন।
লেখক সালেহ মাহমুদ যুক্তি দিয়া, তথ্য-উপাত্ত দিয়া দেখাইয়াছেন যে, ডিলান টমাস, গিনসবার্গ, মায়া অ্যাঞ্জেলোর কবিতার ভাব ভাষা এবং প্রকাশরীতির প্রতিফলন পাওয়া যায় আবদুল হাই শিকদারের কবিতায়। ২০২০ সালের পর হইতে তাহার কবিতা যে, ক্রমশ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের অভিমুখী হইয়া ঈষৎ ভিন্নমাত্রা অর্জন করিয়াছে, তাহার কবিতা যে, বিশ্বজনীন হইয়া উঠিয়াছে তাহাও লেখক গভীরভাবে উপলব্ধি করিয়াছেন।
কবিগণ যে সমাজের আয়না, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ; মহাকবি ইকবালের সেই আপ্তবাক্যের নিদর্শন পাওয়া যায় আবদুল হাই শিকদারের কবিতায়। এমনি করিয়া দুনিয়ার তাবৎ কবি মহাকবি এবং সমালোচকদের উদ্ধৃতিতে ঠাসা গ্রন্থখানি আপনাকে মুগ্ধ করিবে আশা করি। কবির প্রতি অত্যুচ্চ পর্বত প্রমাণ ভালোবাসা কিংবা দৃষ্টিকটু পক্ষপাতিত্বের জন্য বলিতেছি না গুণমুগ্ধ লেখক সালেহ মাহমুদ রিয়াদের নিপুণ হস্তে বিছানো শব্দমালার রসবোধ আহরণের জন্য বলিব পাঠককুল ঠকিবেন না।
অসাধারণ এই গ্রন্থখানি কবি আবদুল হাই শিকদারের ভূমিষ্ঠ হওয়া, শৈশব, কৈশোর, বয়োঃসন্ধি, যৌবন এবং প্রৌঢ়ত্বের প্রত্যেকটি স্তর স্পর্শ করিয়াছে।ভূমিষ্ঠ হইবার সনটি বর্ণিত হইয়াছে এইভাবে,"বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলা পলাশীর আম্রকাননে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে পরাভূত হইয়া শহীদ হন ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে।ইহার শতবর্ষ পরে ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে সেই স্বাধীনতা ফিরাইয়া আনিবার জন্য সুদূর কান্দাহার হইতে এই বঙ্গ অবদি মানুষ ব্রিটিশ বেণিয়াদের বিরুদ্ধে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল কিন্তু ব্যর্থ হইয়াছিল। ইহারও শতবর্ষ পর ১৯৫৭ খ্রীষ্টাব্দে স্বাধীনতার ঝা-া লইয়া কুড়িগ্রাম জেলার অন্তর্গত ভুরুঙ্গামারী উপজেলার দক্ষিণছাট গোপালপুর গ্রামে শিকদার বাড়িতে আবির্ভূত হন আবদুল হাই শিকদার। সেইদিন কেহ কি অনুধাবন করিতে পারিয়াছিল এই শিশু একদিন তাহার কবিতা দিয়া, সাহিত্য সংস্কৃতি দিয়া দেশ মাতাইবে কিংবা দেশের সীমারেখা ছাড়াইয়া পৃথিবীর সন্তান হইয়া উঠিবেন?
লেখক সালেহ মাহমুদ তাহার লেখনীতে সেই সত্যটি তুলিয়া আনিবার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাইয়াছেন এই গ্রন্থের সতেরোটি অনুচ্ছেদে।
প্রারম্ভিক পর্বে ‘জীবনের অভিমুখ’ আলোচনায় কবি বাল্যকালে যে অতীব মেধাবী ছিলেন এবং ছিলেন মওলানা ভাসানীর একনিষ্ঠ শিষ্যরূপ তাহা বিধৃত করিতে ভুলিয়া যান নাই।শিকদার পরিবার যে মওলানা ভাসানীর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে এবং সাম্য প্রভাবে প্রভাভান্বিত তাহাও স্থান করিয়া লইয়াছে গ্রন্থে।তাহার লেখালেখির হাতেখড়ি সেই নবম শ্রেণিতে অধ্যায়নকালে গণেশ রাজা নাটক মঞ্চস্থ করিবার মধ্য দিয়া।কলেজ জীবনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কৃষক সমিতির ছায়াবৃক্ষের ছায়াতলে গঠিত বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী হইয়া দেশের সর্ববৃহৎ রংপুর কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাস কাপাইয়াছেন। পাশাপাশি সাহিত্য কর্মে মনোনিবেশ করিয়া উত্তরবঙ্গের কবি মহলে সাড়া জাগাইয়াছেন। ইহার পর কবির ঢাকায় আগমন এবং প্রকৃত ছন্নছাড়া জীবনে কাব্যচর্চা, সমকালীন কবিমহলে গতায়ন, সাংবাদিকতা, সাহিত্য, সংস্কৃতি,রাজনীতি এবং অবশেষে অধ্যাপনা-রীতিমতো টর্নেডো। প্রতিবন্ধকতা আসিয়াছে বহু, হামলা, মামলাও কম হয় নাই; রাজরোষে পড়িয়া পিতৃপ্রদত্ত জীবননাশ হইবারও উপক্রম হইয়াছিল। কিন্তু প্রতিবারই তিনি বধ্যভূমি হইতে উত্থিত হইয়াছেন আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নেত্রী, মানবাধিকার কর্মী,কবি মায়া অ্যাঞ্জেলোর মতো;
‘তুমি আমার কথা ইতিহাসে লিখে রাখতে পারো,
তোমাদের মিথ্যা আর বানানো গল্প মিশিয়ে,
আমাকে ডুবিয়ে রাখতে পারো পঙ্কিলতার সাগরে,
তবুও, ধুলোর মতো আমি উঠে দাঁড়াই।’
কবি আবদুল হাই শিকদার প্রতিবারই মহাপ্লাবনের পর ধ্বংসস্তূপের মধ্য হইতে ধূলার মতো উঠিয়া দাঁড়াইয়াছেন।
এখন সমাপ্তি টানিবার পালা;কবি আবদুল হাই শিকদারের কাব্যবিশ্ব লইয়া আলোচিত অসাধারণ গ্রন্থখানির অনুচ্ছেদসমূহের শিরোনামেও স্থান দখল করিয়া আছে বৈচিত্র্য : জীবনের অভিমুখ, জীবন ও কবিতা, প্রণয় ও পিপাসা, নিপীড়িতের কণ্ঠস্বর, প্রতিজ্ঞা ও প্রেরণার আত্মপ্রতিকৃতি, পরমপুরুষ ঃ অতীন্দ্রিয় সন্ধান,জীবন ও মৃত্তিকার বিষাদ টঙ্কার,গণনায়কের সন্ধানে, পুজি-প্রকৃতি-পরিবেশ, পরাবৃত্তের মহাবিশ্ব, মহাত্মা পূর্বসূরিঃপ্রণমি তোমারে, শিশু পাঠশালা ঃ আনন্দ ও শিক্ষা, রুবাইয়ের নবরূপ, বাস্তব-পরাবাস্তব-অধিবাস্তব, অনিবার্য অনুপ্রাস এবং উপসংহার।
পরিশিষ্টে স্থান দল করিয়া আছে কবি আবদুল হাই শিকদারের সংক্ষিপ্ত জীবন ও গ্রন্থপঞ্জি,সহায়ক গ্রন্থ এবং নির্ঘন্ট।
শিল্পী এম এ আরিফ তুলির আঁচড়ে যে প্রচ্ছদ উপহার দিয়াছেন তাহাতে গ্রন্থখানি পরিপূর্ণতা লাভ করিয়াছে বলিয়া আমার নিকট মনে হইয়াছে।
অসাধারণ এই গ্রন্থখানি শোভা প্রকাশের কর্ণধার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ছাপার অক্ষরে পাঠকের করকোমলে তুলিয়া দিয়া এক দুঃসাহসী কর্মসাধন করিয়াছেন।অতিশয় ধন্যবাদ প্রাপ্তির অধিকারী তিনিও।
সমাপ্তি টানিবো লেখক সালেহ মাহমুদের সংশয়াবৃত্ত উক্ত উদ্গিরণ করিয়া; ‘আজিকাল এই নবীনযুগে শুনিতে পাই শিক্ষিত, অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত- কেহই এই ধরনের গ্রন্থ পড়িতে বিশেষ আগ্রহ বোধ করেন না। এইরূপ সংবাদের সত্যমিথ্যা নির্ণয় করিয়া দেখিবার বাসনা আমাদিগের নাই। তবে লোক সকল পড়িলে লেখকের সুখ বাড়ে, মনে আনন্দ হয়, প্রকাশক আরাম পান।’- তবে আমি অন্ততঃ জের দিয়া বলিতে পারি পাঠককুল আশাহত করিবেন না গ্রন্থাকারকে।


আরো সংবাদ



premium cement